ফিলিস্তিন যুদ্ধের ১০০ বছর pdf download, কামরুজ্জামান অমিত বই pdf download, filistin juddher 100 bochor pdf download |
একটু পড়ুন:
প্রথম যুদ্ধ ঘোষণা, ১৯১৭-১৯৩৯
যুদ্ধ ঘোষণা দেওয়ার আগেই যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার অনেক উদাহরণ আছে। -আর্থার জেমস বেলফোর
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে, ফিলিস্তিনে জায়নবাদী উপনিবেশের শক্তিশালী আসন গড়ে ওঠার আগে, নতুন ধরনের চিন্তাচেতনার প্রসার লাভ করছিল; আধুনিক শিক্ষা ও জ্ঞানের বিস্তার লাভ করছিল, এবং দেশটির অর্থনীতি বৈশ্বিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সাথে মেলবন্ধনের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছিল। রপ্তানির জন্য গম ও লেবুজাতীয় ফলের উৎপাদন হচ্ছিল। কৃষিখাতে মূলধন বিনিয়োগ, অর্থকরী ফসল ও দিনমজুরির আবির্ভাব হচ্ছিল। কমলা বাগানের লক্ষণীয় বিস্তার লাভ করছিল। এসব কার্যক্রম গ্রামাঞ্চলের বড় অংশের চেহারাই পাল্টে দিচ্ছিল। এই ক্রমবিকাশের পাশাপাশি ব্যক্তিগত জমিগুলোর মালিকানা অল্প কিছু লোকের দখলে চলে আসছিল। বিস্তীর্ণ এলাকাগুলোর নিয়ন্ত্রণ চলে আসছিল সেখানে অনুপস্থিত থাকা জমিদারদের হাতে এদের বেশিরভাগই থাকতেন বৈরুত বা দামেস্কে।
তাদের জমিগুলো দেখাশোনা করতেন ক্ষুদ্র কৃষকরা। স্যানিটেশন, স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও শিশু জন্মহারে ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছিল, মৃত্যু হার হ্রাস পাচ্ছিল। ফলে জনসংখ্যা তুলনামূলক দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। টেলিগ্রাফ, বাষ্পচালিত জাহাজ, রেলপথ, গ্যাসলাইট, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, এবং আধুনিক রাস্তা নির্মাণের ফলে শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতেও পরিবর্তন আসছিল। একইসাথে তখন দেশটির ভেতরে কিংবা বাইরে ভ্রমণ করা হয়ে উঠছিল তুলনামূলক সহজ, দ্রুততর, সস্তা ও নিরাপদ। ১৮৬০ এর দশকে, অটোমান রাজনীতিবিদ ইউসুফ দিয়া আল খালিদিকে বিদ্যা অর্জনের জন্য পশ্চিম অভিমুখে মাল্টা আর ইস্তাম্বুল পর্যন্ত যেতে হয়েছিল।
১৯১৪ সালের দিকে, এ ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা ফিলিস্তিন, বৈরুত, কায়রো আর দামেস্কতেই প্রচলিত ছিল। রাষ্ট্রীয়, ব্যক্তিগত কিংবা মিশনারি স্কুল-কলেজ থেকে শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ ছিল। আধুনিক তাত্ত্বিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তিত হচ্ছিল মূলত বিদেশি মিশনারি স্কুলগুলোর মাধ্যমে। ক্যাথলিক, প্রোটেস্ট্যান্ট, অর্থডক্সের পাশাপাশি বিশ্ব ইসরায়েলি জোটের ইহুদিদের ভুলও কাজ করছিল। বিদেশি মিশনারিরা তাদের শক্তিশালী পৃষ্ঠপোষকদের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দিক নির্দেশনার ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করতে পারে- কিছুটা এমন ভয় থেকেই অটোমান কর্তৃপক্ষ তখন সরকারি স্কুল চালু করতে থাকে; ফিলিস্তিনে বিদেশি স্কুলের চেয়ে এই স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীদের সংখ্যাই বেশি ছিল। সার্বজনীন শিক্ষার সুযোগ ও স্বাক্ষরতার হার বৃদ্ধিতে তখনো অনেক উন্নতি করা বাকি ছিল। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলশ্রুতিতে আসা পরিবর্তনগুলোর কারণে, নতুন নতুন ধ্যানধারণা জনসাধারণের কাছে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এই পরিবর্তনগুলোর কারণে আরব জনগণ উপকৃত হয়েছিল।
সামাজিকভাবে ফিলিস্তিনের বেশিরভাগ অঞ্চলই ছিল গ্রাম অধ্যুষিত। সেখানে পুরুষতান্ত্রিক ও পরিবারতান্ত্রিক ব্যবস্থারই প্রাধান্য ছিল। ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত প্রায় এমন অবস্থাই বিরাজ করে। সেখানে প্রভাব বিস্তার করত সংখ্যালঘু শহুরে অভিজাত শ্রেণির লোকরা, অল্প কিছু সেসব পরিবারের মাঝে আমাদের পরিবারও অন্তর্ভুক্ত ছিল। যুগের পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে নিজেদের সামাজিক অবস্থান আর প্রভাব ধরে রাখার জন্য পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্যরা বিদেশি ভাষা আর আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছিল।
তখন নতুন নতুন পেশা, বাণিজ্য ও শ্রেণির উদ্ভব ঘটছিল; অর্থাৎ, বিংশ শতাব্দীতে সেখানে জীবনযাত্রার মান আরো উন্নত হচ্ছিল। কিন্তু ফিলিস্তিনের রাজনীতি এই অভিজাত শ্রেণিই নিয়ন্ত্রণ করত। জাফফ্ফা ও হাইফার মতো উপকূলীয় শহরগুলোতে উন্নয়নের গতি ছিল আরো দ্রুততর। ফিলিস্তিনের কেন্দ্রের দিকে থাকা রক্ষণশীল জেরুজালেম, নাবলুস ও হেবরন শহরের চেয়ে, এসব শহরের পরিবর্তন আরো বেশি দৃশ্যমান ছিল। উপকূলীয় শহরগুলোতে নব্য পুঁজিবাদী ধনী শ্রেণি ও শহুরে শ্রমিক শ্রেণির বিকাশ লক্ষনীয় ছিল।
একইসাথে জনগণের একটা বড় অংশের আত্মপরিচয়ের মধ্যেও পরিবর্তন আসা শুরু করল। আমার দাদার প্রজন্মের লোকজন পরিবার, ধর্ম ও নিজের শহর বা গ্রামের পরিচয়ে বড় হতেন বা হতে পারতেন। পূর্বসুরিদের কাছ থেকে পাওয়া বংশ পরিচয়কে তারা লালন করতে পারতেন।
পারতেন আরবিভাষী হওয়ায় গর্ববোধ করতে, যা ছিল পবিত্র কুরআনের ভাষা। এবং আরব সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী হওয়া নিয়েও তারা গর্ব করতে পারতেন। অটোমান সাম্রাজ্য ও শাসকদের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করতে পারতেন। এই আনুগত্য ছিল যুগ যুগ ধরে চলে আসা একটা প্রথার মতো। একইসাথে অটোমানদের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গিটা থাকতে পারত মুসলিম সাম্রাজ্যের সবচেয়ে প্রাচীন ও সর্বশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের নিরাপত্তারক্ষী হিসাবে- যে ভূখণ্ডের প্রতি ক্রুসেড যুদ্ধের সময় থেকেই খ্রিস্টানদের লোভনীয় দৃষ্টি ছিল, যে ভূখণ্ডে মক্কা, মদিনা আর জেরুজালেমের মতো শহরগুলো অবস্থিত ছিল। বিংশ শতাব্দীর দিকে এসে অটোমানদের প্রতি এই অঞ্চলের মানুষদের আনুগত্য দুর্বল হয়ে যায়। তখন অটোমান সামরিক বাহিনীর পরাজয় ঘটলে সাম্রাজ্যের ধর্মীয় ভিত্তি দুর্বল হয়ে যায়, আঞ্চলিক অধিকার ক্ষুণ্ন হতে থাকে এবং জাতীয়তাবাদী আদর্শের বিকাশ ঘটে।
কর্ম তৎপরতা বেড়ে যাওয়া ও শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি পাওয়া, এই পরিবর্তনকে আরো ত্বরান্বিত করেছিল। এছাড়া ক্রমবর্ধমান সংবাদমাধ্যম ও ছাপার বই সহজলভ্য হওয়াও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। ১৯০৮ থেকে ১৯১৪ সালের মাঝে ফিলিস্তিনে ৩২টি নতুন পত্রিকা ও সাময়িকী চালু হয়। ১৯২০ ও ১৯৩০ এর দশকে এ সংখ্যাটি আরো বৃদ্ধি পায়। জাতীয়তাবোধের মতো বিভিন্ন ধরনের নতুন ধারণার সৃষ্টি হয়, এবং শ্রমিক শ্রেণির সংহতি ও সমাজে নারীদের অবদান বিষয়ক বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের ধারণার আবির্ভাব ঘটতে থাকে।
এসব ঘটনাক্রম পূর্ববর্তী প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানানো শুরু করে। জাতীয়তা, বিভিন্ন শ্রেণিভুক্ত হওয়া, কিংবা পেশাগত গোষ্ঠী তৈরি হওয়ার ব্যাপারগুলো তখনো প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথে ছিল। এসব ধারণার সাথে সাম্রাজ্যের প্রতি আনুগত্য সাংঘর্ষিক হয়ে উঠছিল। উদাহরণস্বরূপ, ইউসুফ দিয়া ১৮৯৯ সালে আধুনিক জায়নবাদের প্রতিষ্ঠাতা থিওডোর হার্জেলকে এক চিঠিতে জেরুজালেমে প্রচলিত ধর্মীয় সংস্কৃতি, অটোমানদের প্রতি আনুগত্য ও স্থানীয় গৌরব নিয়ে আলোকপাত করেন। এতে ফিলিস্তিনের জাতীয়তাবোধের বিষয়টিও ফুটে ওঠেছিল।
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে, ফিলিস্তিনে যে ইহুদিরা থাকতেন, তাদের বেশিরভাগই তখনো শহরাঞ্চলের মুসলিম ও খ্রিস্টানদের সাথে স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করতেন; সাংস্কৃতিক দিক দিয়েও তাদের মধ্যে অনেকখানি মিল ছিল। তারা বেশিরভাগ ছিলেন আল্ট্রা-অর্থোডক্স ও অ-ইহুদিবাদী বা নন-জায়োনিস্ট, মিজরাহি (প্রাচ্যের ইহুদি) বা সেফারদি ইহুদি (স্পেন থেকে নির্বাসিত হয়ে আসা ইহুদিদের বংশধর) এবং মধ্যপ্রাচ্যের শহরে কিংবা ভূমধ্যসাগরীয় বংশোদ্ভূত, যারা দ্বিতীয় বা তৃতীয় ভাষা হিসাবে আরবি আর তুর্কি ভাষায় কথা বলতে পারতেন। তাদের সাথে প্রতিবেশীদের ধর্মীয় দিক দিয়ে অনেক ভিন্নতা থাকার পরও তারা ভিনদেশি কেউ ছিলেন না; এমনকি তারা ইউরোপীয় বা বসতি স্থাপনকারীও ছিলেন না। তারা নিজেদের দেখতেন স্থানীয় মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলের ইহুদি সমাজের অংশ হিসাবে। উপরন্তু, ওই সময়ে ইউরোপ থেকে এসে বসতি স্থাপনকারী আশকেনাজি ইহুদিরা শুরুতে চেয়েছিলেন স্থানীয় সমাজের সাথে মিশে যেতে, যাদের মাঝে ডেভিড বেন গুরিয়ন আর ইজাক বেন জভির মতো কাঁটার জায়নবাদীরাও ছিলেন। এমনকি, বেন গুরিয়ন ও বেন জতি অটোমান নাগরিকত্বও নিয়ে নেন এবং ইস্তাম্বুলে পড়াশোনা করে আরবি ও তুর্কি ভাষা শেখেন। পরবর্তীতে এদের একজন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ও অন্যজন প্রেসিডেন্ট হন।
আধুনিক শিল্প যুগে, বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় পশ্চিম ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার দেশগুলো দ্রুত উন্নতি করতে থাকায়, বাইরের পর্যবেক্ষকদের অনেকেই ভুল ব্যাখ্যা দেন- ফিলিস্তিনের মতো মধ্যপ্রাচ্যের সমাজগুলো ওই সময় স্থিতিশীল বা অপরিবর্তনীয় ছিল, এমনকি “অবনমন” এর দিকেও যাচ্ছিল; এদের মাঝে অনেক বিশিষ্ট পণ্ডিতবর্গও আছেন। আমরা এখন জানি এই তথ্যগুলো সঠিক নয়। অটোমান, ফিলিস্তিনি, ইসরায়েলি ও পশ্চিমা বিশ্বের উৎস থেকে এই অঞ্চলের ইতিহাস নিয়ে গভীরভাবে গবেষণালব্ধ ফলাফল এসব ধারণাকে খারিজ করে দেয়। বিদেশিদের এই অঞ্চল নিয়ে যে ধারণাই থাকুক, এটা স্পষ্ট যে বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে অটোমানদের অধীনে থাকা ফিলিস্তিন, এর নিকটবর্তী মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য সমাজগুলোর মতোই দ্রুত উন্নয়নশীল অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল।
★বাহ্যিক কোনো আঘাত আসলে সমাজে এর বড় প্রভাব পড়ে, বিশেষ করে তাদের নিজস্বতায়। বলকান, লিবিয়া ও অন্যান্য অঞ্চলের কর্তৃত্ব হারিয়ে, বিংশ শতাব্দীর শুরুতে অটোমান সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়তে শুরু করে। প্রায় এক দশক ধরে ক্রমাগত বড় বড় যুদ্ধের আঘাতে জর্জরিত হয়ে পড়ে সাম্রাজ্যটি। শুরুটা হয় ১৯১১-১২ সালের লিবিয়ান যুদ্ধ দিয়ে। এরপর ১৯১২-১৩ সালের বলকান যুদ্ধ, এবং পরবর্তীতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কা, যা সাম্রাজ্য ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। চার বছরের প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে অভাব-অনটন, দুর্ভিক্ষ আর রোগবালাই দেখা দেয়। কর্মক্ষম পুরুষদের বেশিরভাগ অংশকেই বাধ্যতামূলকভাবে সৈন্যদলে নিয়োগ দেওয়া হয়, যাদের ফ্রন্টে পাঠানো হয়; সাথে মালবাহী গৃহপালিত প্রাণীও পাঠাতে হয়। ফিলিস্তিন ও বর্তমানের জর্ডান, সিরিয়া ও লেবানন নিয়ে গঠিত বৃহত্তর সিরিয়াতে ১৯১৫ থেকে ১৯১৮ সালের মধ্যে শুধু দুর্ভিক্ষের কারণেই পাঁচ লক্ষ মানুষ মারা যায় (সংখ্যাটা অনেকেই মাত্রাতিরিক্ত বাড়িয়ে বলে থাকেন)।
ক্ষুধা ও সার্বিক অসচ্ছলতাই ছিল জনসাধারণের ভয়াবহ অবস্থার একমাত্র কারণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বেশিরভাগ গবেষকই পশ্চিমা ফ্রন্টের হতাহত অবস্থার ভয়াবহতার দিকে বেশি গুরুত্ব দেন। কিন্তু খুব কম লোকই উপলব্ধি করতে পারেন, যেকোনো যুদ্ধরত বাহিনীর মধ্যে অটোমান সাম্রাজ্য সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছিল। তাদের ত্রিশ লক্ষেরও বেশি মানুষ মারা যায়, যা ছিল মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ; তাদের বেশিরভাগই ছিল বেসামরিক নাগরিক। তাছাড়া, যুদ্ধে পাঠানো ২৮ লক্ষ সৈনিকদের প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ সৈনিকই মারা যায়। অনুরূপভাবে আরবদের হতাহতের সংখ্যাও বেশি ছিল। কারণ, ইরাক ও বৃহত্তর সিরিয়া থেকে যে সৈনিকদের নিয়োগ দেওয়া হয়, তাদের অটোমান পূর্ব ফ্রন্টে রাশিয়ার বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সম্মুখীন হতে হয়। এছাড়া গালিপলি, সিনাই, ফিলিস্তিন ও ইরাকের ফ্রন্টেও প্রচুর প্রাণ হারাতে হয়। জনসংখ্যাবিদ জাস্টিন ম্যাকার্থি অনুমান করেন- ১৯১৪ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনের জনসংখ্যা যেখানে বার্ষিক এক শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছিল, সেখানে যুদ্ধের সময় তাদের জনসংখ্যা ছয় শতাংশ কমে যায়।
ওই সময়ের টালমাটাল অবস্থা আমাদের মতো সচ্ছল পরিবারগুলোকেও ছেড়ে কথা বলেনি। ১৯১৫ সালে যখন আমার বাবা ইসমাইলের জন্ম হয়, তার বড় চার ভাই- নুমান, হাসান, হুসেইন ও আহমাদকে বাধ্যতামূলকভাবে অটোমান সেনাবাহিনীর হয়ে যুদ্ধে যেতে হয়। দুইজন লড়াই করতে গিয়ে আহত হন, কিন্তু সৌভাগ্যজনকভাবে সকলেই জীবিত অবস্থায় ফিরে আসেন। আমার ফুপু আনবারা সালাম আল-খালিদি, বৈরুতের রাস্তায় মানুষজনের অনাহারের কষ্ট আর বিয়োগবেদনার ভয়াবহ ছবিগুলোর কথা স্মরণ করেন, যেখানে তিনি তরুণী বয়সে বসবাস করতেন। আমার চাচা হুসেইন আল-খালিদি যুদ্ধের সময় মেডিকেল অফিসার হিসাবে কাজ করতেন। তিনিও জেরুজালেমের এরকম হৃদয়গ্রাহী দৃশ্যের কথা স্মরণ করেন, যেখানে তিনি বিপুল সংখ্যক মানুষকে রাস্তায় অনাহারের ফলে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেছেন।
অটোমান কর্তৃপক্ষের যুদ্ধকালীন বলপূর্বক কার্যক্রমের একটি ছিল আরব জাতীয়তাবাদীদের প্রতারণার দায়ে ফাঁসিতে ঝুলানো, যার মাঝে আমার ফুপুর হবু স্বামী আব্দাল গনি আল উরাইশি-ও ছিলেন।
১৯১৭ সালে জাফা অঞ্চলের অন্যান্য অধিবাসীদের সাথে আমার দাদা হাজী রাগিব আল-খালিনি ও দাদী আমিনা, অটোমান কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে উচ্ছেদের আদেশ পান। আসন্ন যুদ্ধের ভয়াবহতা এড়ানোর জন্য তারা সবচেয়ে ছোট চার বাচ্চাকে সাথে নিয়ে জাফ্ফার নিকটবর্তী তাল আল-রিশে (আমার দাদা সেখানে একজন বিচারক হিসাবে কাজ করায় জেরুজালেম থেকে অনেক বছর আগেই তাদের সেখানে যেতে হয়) তাদের বাড়ি ফেলে যান, যাদের মাঝে একজন ছিলেন আমার বাবা। পরবর্তী কয়েক মাস জাফফার পূর্ববর্তী পাহাড়ি গ্রাম দায়ের গাসানেহতে, পরিবারটি শরণার্থী হিসাবে অবস্থান করে বারঘৌতি গোত্রের সাথে; তাদের সাথে আমার পরিবারের দীর্ঘদিন ধরেই যোগাযোগ ছিল। ওই গ্রামটি সমুদ্র থেকে অনেক দূরে ছিল, যার কারণে মিত্রপক্ষের নৌবাহিনীর অস্ত্রের আয়ত্বের বাইরে ছিল, এবং উপকূলবর্তী অঞ্চলে উত্তর দিকে অগ্রসর হওয়া জেনারেল স্যার এডমন্ড অ্যালেনবিয়ের অধীনে থাকা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর তুমুল সংঘর্ষ থেকেও দূরে ছিল।
১৯১৭ সালের বসন্ত থেকে শরতের শেষ পর্যন্ত দেশটির দক্ষিণাঞ্চল, ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে জার্মান ও অস্ট্রিয়ার সেনাবাহিনীর সমর্থনপুষ্ট অটোমানদের যুদ্ধে নাকাল হয়ে যায়। লড়াইগুলোর মধ্যে ছিল পরিখা যুদ্ধ, বিমান হামলা, এবং স্থল ও নৌবাহিনীর তীব্র কামানের গোলাবর্ষণ। ব্রিটিশদের তীব্র আক্রমণাত্বক কার্যক্রমের ফলে অটোমান প্রতিরক্ষা বাহিনী ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়তে থাকে। শীতের সময়ে লড়াই ছড়িয়ে পড়ে ফিলিস্তিনের উত্তরাঞ্চলে (ফিলিস্তিনের কেন্দ্রে থাকা জেরুজালেম ১৯১৭ সালের ডিসেম্বরে ব্রিটিশদের দখলে চলে আসে), যা ১৯১৮ সালের শুরুর দিকের সময় পর্যন্ত চলতে থাকে। অনেক অঞ্চলে যুদ্ধের প্রত্যক্ষ প্রভাবে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এর মাঝে সবচেয়ে বেশি আক্রমণের শিকার হয় গাজা, এবং এর নিকটবর্তী অন্যান্য শহর ও গ্রামগুলো। এসব অঞ্চলের বেশিরভাগ জায়গা পরিখার যুদ্ধে ব্রিটিশদের ভারী গোলাবর্ষণ, এবং ভূমধ্যসাগরীয় উপকূল দিয়ে ধীর গতিতে আসতে থাকা মিত্রবাহিনীর আক্রমণের কারণে ধ্বংস হয়ে যায়।
১৯১৭ সালের নভেম্বরে জাফফ্ফা ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসার পর, আমার দাদার পরিবার তাল আল-রিশের বাড়িতে ফিরে আসে।
ওই সময়টায় থাকা আট বছর বয়সী আমার আরেক ফুপু ফাতিমা আল-খালিদি সালাম স্মরণ করেন- দাদা ব্রিটিশ সেনাদের ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে, “ওয়েলকাম, ওয়েলকাম” বলে স্বাগত জানাচ্ছিলেন। এদিকে দাদী এটাকে শুনছিলেন, “ইয়া ওয়েলকুম"; আরবিতে যার অর্থ, “আপনার ওপর অভিশাপ নেমে আসুক”। তিনি ভীত হয়ে ভাবছিলেন, দাদা বিদেশি সেনাদের সাথে ঠাট্টা করে পরিবারকে বিপদে ফেলে দিচ্ছেন কিনা। হাজী রাগিব আল-গালিদি ব্রিটিশদের আপ্যায়ন করে থাকুন কিংবা খেদ জানিয়ে থাকুন, তার পরিবার তখন একটা বিপজ্জনক অবস্থায় ছিল। কারণ, তার দুই ছেলে তখনো অন্য প্রান্তে যুদ্ধরত এবং বাকি দুই ছেলে যুদ্ধবন্দী অবস্থায়। দুই চাচাও অটোমান সেনাবাহিনীতে ছিলেন। তাদের বাহিনী ১৯১৮ সালের শেষ দিক পর্যন্ত, উত্তর ফিলিস্তিন ও সিরিয়াতে ব্রিটিশদের প্রতিরোধ করে রেখেছিল।
তারা ছিলেন যুদ্ধের শেষেও নিখোঁজ থাকা হাজার হাজার পুরুষদের অংশবিশেষ। এদের কেউ কেউ যুদ্ধে বাধ্যতামূলক অংশগ্রহণ এড়ানোর জন্য আমেরিকায় পালিয়ে যান। অন্যদিকে লেখক আরিফ শেহাদেহ ( পরবর্তীতে আরিফ আল আরিফ নামে পরিচিত) মতো অনেকেই মিত্রবাহিনীর বন্দীশিবিরে যুদ্ধবন্দী অবস্থায় ছিলেন। অন্যরা সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য পাহাড়ে লুকিয়ে ছিলেন, যাদের মধ্যে ছিলেন হাইফা শহরের স্পষ্টভাষী জায়নবাদ বিরোধী পত্রিকা আল- কারমিল এর সম্পাদক নাজিব নাসের। এদিকে, কিছু আরব সেনা অটোমান সেনাবাহিনী ত্যাগ করে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে যায়, অথবা শরীফ হুসেইনের নেতৃত্বে বিদ্রোহী আরব বাহিনীতে যোগ দেয়, এবং ব্রিটেনের সাথে জোট গঠন করে। এছাড়া, ফিলাস্তিন এর সম্পাদক ইসা আল ইসা, তার উগ্র আরব জাতীয়তাবাদী মনোভাবের কারণে অটোমান কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্বাসনে প্রেরিত হন। তার মতো অন্যান্য আরো অনেককে জাফফা থেকে আনাতোলিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
যুদ্ধের এই তীব্র আঘাত ও যুদ্ধ পরবর্তী রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রভাব, জনগণের দীর্ঘদিন ধরে ধারণ করে আসা আত্মপরিচয় নিয়ে পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ফিলিস্তিন ও আরব অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষ ইউরোপীয় সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। চারশত বছর পর তারা বিদেশিদের নিয়ন্ত্রণের মুখোমুখি হয়। অটোমানদের নিয়ন্ত্রণ দ্রুত বিলীন হয়ে যায়, যা বিশ প্রজন্মেরও বেশি মানুষের একমাত্র সরকার ব্যবস্থা ছিল।
এক যুগ শেষ হয়ে যখন নতুন যুগ শুরু হচ্ছিল- এই যন্ত্রণা, হারানোর বেদনা, বঞ্চনার মধ্যে থাকা ফিলিস্তিনিদের সামনে তখন নতুন আরেক আঘাত চলে আসে; আর সেটা হলো 'বেলফোর ঘোষণা'।
★ গুরুত্বপূর্ণ এই ঘোষণাটি আসে ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর, ব্রিটেনের মন্ত্রিপরিষদের পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস বেলফোরের কাছ থেকে, যা পরবর্তীতে ‘বেলফোর ঘোষণা' হিসাবে পরিচিত হয়; এটা ছিল কেবল একটা বাক্য:
- মহামান্য সরকার ফিলিস্তিনে ইহুদি জনগণের জন্য একটা জাতীয় আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার পক্ষে, এবং এই উদ্দেশ্য অর্জন সহজতর করার জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা করবে, এটা স্পষ্ট করা হচ্ছে যে, এর কারণে ফিলিস্তিনে বসবাসরত অ-ইহুদিদের নাগরিক ও ধর্মীয় অধিকার ক্ষুণ্ণ করা হবে না, এবং অন্যান্য যেকোনো দেশে অবস্থান করা ইহুদিদের অধিকার ও রাজনৈতিক মর্যাদা হানি করা হবে না।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে দূরদর্শী ফিলিস্তিনিরা যদি জায়নবাদী আন্দোলনকে হুমকি হিসাবে দেখে থাকেন, বেলফোর ঘোষণা এখানে নতুন আরেক ভয়ঙ্কর মাত্রা যোগ করে। কূটনৈতিক কোমল ভাষার মাধ্যমে বিভ্রান্তিকর কিছু বক্তব্যের সাথে, এই ঘোষণাতে “ইহুদিদের জন্য একটা জাতীয় আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করা হয়। থিওডোর হার্জেল সমগ্র ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্রের ধারণা দিয়েছিলেন, যেখানে ইহুদিদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা ও অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ করা হবে। বেলফোর ঘোষণা যেন আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দেয়, ব্রিটেনেরও তার
প্রতি সমর্থন আছে। আরেকটা উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে, ফিলিস্তিনের জনগণের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ আরবদের নিয়ে বেলফোরে কিছু উল্লেখ করা ছিল না। শুধুমাত্র “ফিলিস্তিনের অ-ইহুদি সম্প্রদায়" বলে দায় মেটানো হয়েছিল। ওই সময় মোট জনসংখ্যার ৯৪ শতাংশই ছিল আরব।
বেলফোর ঘোষণার ৬৭ শব্দে তাদেরকে ফিলিস্তিনি” বা “আরব” বলে সম্বোধন করা হয়নি। সংখ্যাগরিষ্ঠ এই জনতার জন্য কেবল “নাগরিক ও ধর্মীয় অধিকার” ভোগ করার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। রাজনৈতিক বা জাতিগত অধিকারের কোনো প্রসঙ্গ আসেনি। অন্যদিকে বেলফোরে “ইহুদি জনগণ” এর নাম উল্লেখ করে তাদের জাতিগত অধিকারের কথা বর্ণনা করা হয়, যারা কিনা ১৯১৭ সালে দেশটির মোট অধিবাসীর মাত্র ছয় শতাংশ ছিল।
ব্রিটিশদের সমর্থন নিশ্চিত করার আগে জায়নবাদী আন্দোলন ছিল একটা ঔপনিবেশিক প্রকল্প, যা একটা পরাশক্তি রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতার খোঁজ করছিল। অটোমান সাম্রাজ্য, উইলহেমিন জার্মানি, এবং অন্যান্য জায়গায় পৃষ্ঠপোষক যোগাড় করতে ব্যর্থ হয়ে থিওডোর হার্জেলের উত্তরসূরি হাইম ওয়াইজম্যান ও তার সহকর্মীরা শেষ পর্যন্ত সফল হন। তারা ডেভিড লয়েড জর্জের নেতৃত্বে যুদ্ধকালীন ব্রিটিশ মন্ত্রিপরিষদের সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হন। ব্রিটিশরা ছিল ওই সময়ের বৃহত্তম পরাশক্তি। ফিলিস্তিনিরা তখন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিল। ওই মুহূর্তেই ব্রিটিশ সেনারা তাদের দেশের উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে দেশটি দখল করে নিচ্ছিল। এই সেনাদের সরকার ইহুদিদের কাছে একটা "জাতীয় আবাসস্থল" নির্মাণ করার অঙ্গীকার করেছিল। এর মাধ্যমে সীমাহীন অভিবাসনের মাধ্যমে ভবিষ্যতে ইহুদি। সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজ প্রতিষ্ঠা করার দিকে ইঙ্গিত করছিল।
ওই সময়ে ব্রিটিশ সরকারের উদ্দেশ্য কী ছিল, তা নিয়ে গত শতাব্দীতে যথেষ্ট বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তাদের অনেকগুলো উদ্দেশ্যের মধ্যে সেমিটিক ও অ্যান্টি-সেমিটিক, দুই ধরনের মতবাদই কার্যকর ভূমিকা রেখেছিল। তারা একইসাথে হিব্রুভাষীদের সেমেটিক দর্শন অনুযায়ী বাইবেলের পূণ্যভূমি “ফিরিয়ে” দিতে চেয়েছিল এবং ব্রিটেনে ইহুদি অভিবাসন কমানোর অ্যান্টি-সেমিটিক কামনাও পূরণ করেছিল। এখানে আরেকটা মতবাদ কাজ করছিল; ধারণা করা হয়, বিপ্লবী রুশ বাহিনীকে যুদ্ধে লড়াইয়ে রাখা ও যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধে নিয়ে আসার ক্ষমতা “বিশ্ব ইহুদি” জাতির কাছেই ছিল। তবে এসব আবেগীয় ব্যাপার সরিয়ে রাখলে, ব্রিটেনের ফিলিস্তিন নিয়ন্ত্রণের মূল কারণ ছিল ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্য।
তাদের সেই আকাঙ্ক্ষা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকেই ছিল, যা যুদ্ধের সময়ে পরিপূর্ণতা পায়। ফিলিস্তিন দখল নিয়ে ব্রিটিশদের অন্যান্য অনুপ্রেরণা যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক, ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্যই ছিল মূল কারণ; পরার্থপরতার জন্য তারা এ কাজ করেছে, এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই। ব্রিটিশদের কৌশলগত স্বার্থ জায়নবাদী প্রকল্পের সাথে পুরোপুরি মিলে যায়। এটা ছিল ব্রিটিশদের দেওয়া যুদ্ধকালীন আঞ্চলিক কতগুলো প্রতিশ্রুতির একটি, যা তাদের স্বার্থ রক্ষা করে। ব্রিটিশদের অন্যান্য প্রতিশ্রুতির মাঝে ছিল ১৯১৫ ও ১৯১৬ সালে মক্কার শরীফ হোসেইনের নেতৃত্বে আরবদের স্বাধীনতার অঙ্গীকার দেওয়া, এবং ১৯১৬ সালে ফ্রান্সের সাথে গোপন সাইকস-পিকো চুক্তি, যেখানে দুই পরাশক্তি একমত হয়, তারা পূর্ব আরবদেশীয় অঞ্চলগুলোতে উপনিবেশ ভাগাভাগি করে নেবে।
বেলফোর ঘোষণার পেছনে ব্রিটিশদের উদ্দেশ্যের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, এর ফলে জায়নবাদী আন্দোলনের লক্ষ্য পরিষ্কার হয়ে যায়- ফিলিস্তিনের সার্বভৌমত্ব ও সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দখল করা। ব্রিটিশদের সমর্থনে জায়নবাদীদের এই লক্ষ্য হঠাৎ করে সম্ভাবনাময় হয়ে উঠল। কয়েকজন প্রথম সারির ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ জায়নবাদী আন্দোলন নিয়ে খুব দৃঢ়ভাবে কাজ করেন। যার ফলে এটা শুধু কাগুজে ঘোষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ১৯২২ সালে বেলফোরের বাড়িতে এক ডিনারে, ওই সময়ের অত্যন্ত তিন গুরুত্বপূর্ন ব্রিটিশ নেতা- লয়েড জর্জ, বেলফোর, এবং উপনিবেশ বিষয়ক পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল, ওয়াইজম্যানকে আশ্বাস দেন, তারা “ইহুদিদের জাতীয় আবাসভূমি” বলতে “সবসময়ই ভবিষ্যতের ইহুদি রাষ্ট্রকে বোঝাচ্ছিলেন”। লয়েড জর্জ জায়নবাদী নেতাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন, তারা ফিলিস্তিনের প্রতিনিধিত্বকারী সরকার গঠন করতে দেবেন না।
রুশ জায়নবাদী লেখক জেভ জাবোতিনিস্কির ভাষায়, জায়নবাদীদের অভিযান তখন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর “লৌহ দেওয়াল” এর সমর্থন পেয়েছিল। কিন্তু, ইতোমধ্যে ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়ে যাওয়া ফিলিস্তিনের অধিবাসীদের জন্য, বেলফোরের সতর্কভাবে হিসাব কষে করা গদ্যরচনাটি ছিল অনেকটা তাদের মাথায় বন্দুক তাক করে রাখার মতো। এটা ছিল স্থানীয় আধিবাসীদের প্রতি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের যুদ্ধ ঘোষণা। ফিলিস্তিন তখন প্রায় পুরোটাই আরবদের অধীনে ছিল এবং সেখানে আরব সংস্কৃতির প্রাধান্য ছিল। কিন্তু তখন ইহুদিদের অবাধ অভিবাসনের কারণে সেখানকার অধিবাসীরা সংখ্যালঘু হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হলো। বেলফোর ঘোষণার উদ্দেশ্য এটা হয়ে থাক বা না থাক, এর ফলে একটা উপনিবেশীয় সংকটের বিস্ফোরণ ঘটে, যা এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনিদের জন্য দুর্দশা নিয়ে আসে।
বেলফোর ঘোষণা নিয়ে ফিলিস্তিনিদের প্রতিক্রিয়া আসে একটু দেরিতে। শুরুতে তারা তুলনামূলক নীরব ছিল। বিশ্বের অন্যান্য স্থানে ব্রিটিশদের বক্তব্য ঘোষণার পরপরই ছড়িয়ে পড়ে। ফিলিস্তিনে যুদ্ধের শুরু থেকেই স্থানীয় পত্রিকাগুলো বন্ধ ছিল। এর কারণ ছিল একইসাথে সরকারের সেন্সরশিপ, এবং অটোমান বন্দরে মিত্রবাহিনীর কঠোর অবরোধ থাকায় পত্রিকা ছাপানোর কাগজ না থাকা। ১৯১৭ সালের ডিসেম্বরে ব্রিটিশ সেনারা জেরুজালেম দখল করার পর, ব্রিটিশ সামরিক শাসন বেলফোর ঘোষণা নিয়ে খবর প্রকাশ করার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ আসলে প্রায় দুই বছর ফিলিস্তিনে কোনো সংবাদপত্র প্রকাশের অনুমতি দেয়নি। বেলফোর ঘোষণার খবর শেষ পর্যন্ত ফিলিস্তিনে পৌঁছায় লোকমুখে, এবং কায়রো থেকে আসা ভ্রমণকারীদের সাথে নিয়ে আসা মিসরীয় পত্রিকাগুলোর মাধ্যমে।
যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এই বিশৃঙ্খল সময় থেকে জীবিত ফেরা ব্যক্তিরা যখন বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন, তখন এই পরাজিত ও ক্লান্ত সম্প্রদায়ের কাছে বেলফোর ঘোষণাটা আকস্মিক বিস্ময় হয়ে আসে। এই খবর দেখে তাদের বিস্ময়কর প্রতিক্রিয়া দেখানোর প্রমাণও পাওয়া যায়। ১৯১৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাসনে থাকা ৩৩ জন ফিলিস্তিনি আনাতোলিয়া থেকে দামেস্তে আসতে সক্ষম হন, যাদের মধ্যে আল ইসাও ছিলেন। দামেস্কে খবর প্রচারের নিষেধাজ্ঞা ছিল না। শরণার্থীদের কাছে একটা অগ্রীম চিঠি আসে, যেখানে ফ্রান্সের ভার্সাইয়ে ও ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরে আহ্বান করা শান্তি সম্মেলনের প্রতিবাদের কথা বলা হয়। তারা তখন জোর দিয়ে বলেন, “এই দেশ(ফিলিস্তিন) আমাদের দেশ”। তারা জায়নবাদীদের “ফিলিস্তিনকে তাদের জাতীয় আবাসভূমিতে রূপান্তর" করার দাবি করতে দেখে আতঙ্কিত মনোভাব প্রকাশ করেন।
বেলফোর ঘোষণা প্রচারের সময় এমন সম্ভাবনা অনেক ফিলিস্তিনির কাছেই হয়তো পরিচিত ছিল না। তবে ইউসুফ দিয়া আল-খালিদির মতো দূরদর্শী ব্যক্তিরা, জায়নবাদের সংকট আরো আগেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। ১৯১৪ সালে ইসা আল-ইসা ফিলাস্তিন পত্রিকায় একটা বিচক্ষণ সম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন, “এই ফিলিস্তিনের মাটিতে জায়নবাদীদের স্রোতের ধাক্কায় একটা জাতি বিলুপ্ত হওয়ার পথে... একটা জাতি তার নিজের জন্মভূমি থেকেই বিতাড়িত হওয়ার হুমকিতে।” ইহুদিরা স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে বিস্তীর্ণ উর্বর ভূমি কিনে তাদের তাড়িয়ে দিচ্ছিল, আর সেখানে ইহুদি অভিবাসীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ইহুদিদের এমন উপস্থিতি দেখেই জায়নবাদী আন্দোলন নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন তারা।
১৯০৯ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত প্রায় চল্লিশ হাজার ইহুদি অভিবাসী ফিলিস্তিনে আসে (যদিও কিছু সংখ্যক খুব দ্রুতই আবার চলে যায়) এবং তারা ১৮টি নতুন বসতি স্থাপন করে। এগুলো বসতি স্থাপনের জায়গাগুলো তারা কিনেছিল মূলত দেশের বাইরে থাকা জমিদারদের কাছ থেকে। তুলনামূলক সাম্প্রতিক সময়ে সরকার ব্যক্তিগত মালিকানার সুযোগ করে দেওয়ায় তাদের এই জমিগুলো ক্রয় করতে সুবিধা হয়েছিল। এর প্রভাব বেশি পরিলক্ষিত হয়। ফিলিস্তিনের কৃষি সম্প্রদায়ে। বিশেষভাবে উপকূলীয় অঞ্চল এবং উত্তরাঞ্চলের মারজ ইবন আমির ও হলেহ উপত্যকার ভূমিতে, যেখানে জায়নবাদীদের শক্তিশালী উপনিবেশ গড়ে উঠছিল।
নতুন বসতির আশপাশের গ্রামগুলোতে থাকা কৃষকরা তাদের পাশের জমি বিক্রি হয়ে যাওয়ার কারণে, তাদের নিজেদের প্রাপ্য জমি থেকে বঞ্চিত হয়। অনেককে ইউরোপীয় ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের প্রথম প্যারামিলিটারি বাহিনীর সশস্ত্র আক্রমণের সম্মুখীন হতে হয়। স্রোতের মতো ইহুদিদের আসতে দেখে, যুদ্ধের কয়েক বছর আগে থেকেই হাইফা, জাফফা ও জেরুজালেমের শহুরে আরবরা আশংকা প্রকাশ করে আসছিলেন। বেলফোর ঘোষণা প্রচারের মাধ্যমে ফিলিস্তিনের সার্বভৌমত্বের কফিনে শেষ পেরেক ঠোকার ইঙ্গিত আরো স্পষ্ট হয়ে উঠে।
FAQ:
বই: ফিলিস্তিন যুদ্ধের ১০০ বছর বইটির pdf download Link
ফিলিস্তিন যুদ্ধের ১০০ বছর বইটির লেখক কে?
(লেখক: রশিদ খালিদি)
ফিলিস্তিন যুদ্ধের ১০০ বছর বইটির অনুবাদক কে?
(কামরুজ্জামান অমিত (অনুবাদক)
ফিলিস্তিন যুদ্ধের ১০০ বছর বইটির কোন প্রকাশনী?
শিরোনাম প্রকাশন
ফিলিস্তিন যুদ্ধের ১০০ বছর বইটি কোন বিষয়ে লেখা?
(বিষয়: ইসলামি ইতিহাস ও ঐতিহ্য)
ফিলিস্তিন যুদ্ধের ১০০ বছর বইটির মধ্যে কত পৃষ্ঠা আছে?
(272 পৃষ্ঠা আছে)
ফিলিস্তিন যুদ্ধের ১০০ বছর pdf download করতে নিচে ডাউনলোড বাটন ক্লিক করুন।