বিয়ে স্বপ্ন থেকে অষ্টপ্রহর pdf download, মির্জা ইয়াওয়ার বেইগ বই pdf download, biye shopno tehke oshtopohor pdf download |
একটু পড়ুন:
বিবাহিত জীবনকে সুখী করার উপায়?
আপনি এখন বিবাহিত। আসুন, দেখি বিবাহিত জীবনকে কীভাবে সুন্দর করা যায়। দাম্পত্য জীবনকে কীভাবে সুন্দর করা যায় সেটা নিয়ে একজন আমাকে একবার ২০টি প্রশ্ন করেছিল। এখানে সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিচ্ছি। আশা করি এর মধ্যে দাম্পত্য জীবনের প্রয়োজনীয় সকল বিষয়ের আলোচনাই চলে এসেছে।
সুন্দর দাম্পত্য জীবনের বৈশিষ্ট্য কী?
আ করা যায়। দাম্পত্য জীবনকে কীভাবে সুন্দর করা যায় সেটা নিয়ে একজন আমাকে একবার ২০টি প্রশ্ন করেছিল। এখানে সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিচ্ছি। আশা করি এর মধ্যে দাম্পত্য জীবনের প্রয়োজনীয় সকল বিষয়ের আলোচনাই চলে এসেছে।
সত্য বলা, যত্ন নেওয়া, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ — এই তিনটি গুণকে আমি সুখী দাম্পত্য জীবনের মূলসূত্র হিসেবে গণা করে থাকি। খেয়াল করুন, এখানে আমি "ভালোবাসা' শব্দটি ব্যবহার করিনি। কারণ, ভালোবাসা মূলত সৃষ্টিই হয় এই তিনটি বিষয় থেকে। প্রচলিত অর্থে যাকে ভালোবাসা বলা হয় তা নিছক শারীরিক কামনা। শুধু কারও শারীরিক সৌন্দর্য কখনো ভালোবাসার অনুপ্রেরণা হতে পারে না। সেটা হয়তো ক্ষণিকের মোহ এবং কামনা সৃষ্টি করতে পারে, কিন্তু তা সত্যিকার ভালোবাসা নয়। দীর্ঘদিন এক সাথে থাকা ও জানাশোনার মধ্য দিয়ে যে ভালোবাসা গড়ে ওঠে সে ভালোবাসাই দীর্ঘস্থায়ী হয়। এমন ভালোবাসা গড়তে প্রয়োজন পরস্পরের প্রতি সততা, যত্ন ও সচেতনতা। প্রয়োজন নিজের জীবন সঙ্গীকে নিজের উপর প্রাধান্য দেওয়ার মানসিকতা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ।
সম্মান ছাড়া কখনোই ভালোবাসা জন্ম নিতে পারে না। আপনাকে আপনার জীবনসঙ্গীকে সম্মান করতে হবে, তার গুণগুলোর মূল্যায়ন করতে হবে, তাকে আপনার জীবনের সঙ্গী হিসেবে পেয়ে গর্ববোধ করতে হবে। এটা হৃদয়ে এমন এক ভালোবাসার প্রদীপ জ্বেলে দেয় যা সময়ের সাথে সাথে আরও উজ্জ্বল হতে থাকে। কারণ, সম্মান করার কারণগুলোও সময়ের সাথে সাথে বেড়ে যেতে থাকে।
আর শারীরিক আকর্ষণ বয়স বাড়ার সাথে সাথে কমে যায়। মানুষ এভাবেই তৈরি। বয়স বেড়ে গেলে কেউ আরও বেশি সুন্দর হয় না; বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষ আরও পরিণত হয়, জ্ঞানী হয়; আরও বেশি কোমল, শান্ত ও ধৈর্যশীল হয়; সম্মান পাওয়ার বেশি যোগ্য হয়। এসবের কারণে যে ভালোবাসা গড়ে ওঠে' সে ভালোবাসা সময়ের সাথে সাথে বাড়তে থাকে।
যেমনটা অনুভূত হয়, অকপটে তেমনটা প্রকাশ করাই হচ্ছে সত্য। আর যত্ন নেওয়া মানে হলো, অন্যকে সচেতনভাবে খেয়াল করা। কেননা আপনি জানেন আপনার এবং তার মাঝে কোনো বাধার প্রাচীর নেই। সম্মান হচ্ছে আপনাকে বিশ্বাস করে আপনার সঙ্গী তার হৃদয়ের মণিকোঠায় আপনাকে যে বিশেষ স্থান দিয়েছে—সেই বিশ্বাসের সঠিক মূল্য দেওয়া। যে বিশেষ অধিকার আপনাকে দেওয়া হয়েছে, সেই অধিকারের প্রাপ্য মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখা। কোনো কারণেই এ বিশ্বাসের যেন অমর্যাদা করা না হয়।
দাম্পত্য জীবনে সুখী হওয়ার কি কোনো সূত্র আছে?
এমন কাউকে বিয়ে করুন যাকে দেখে অনুকরণ করতে ইচ্ছে হয়; যাকে শ্রদ্ধা করা যায় এবং যার কাছ থেকে ক্ষমা করা শেখা যায়। অসুখী দাম্পত্যজীবনের সূত্র হলো, এমন কাউকে বিয়ে করা যাকে আপনি বদলে ফেলতে পারবেন বলে মনে করেন। এমন ধারণা পোষণ করলে দাম্পত্য জীবনে বিপর্যয় সৃষ্টি হবেই। কারও পরিবর্তন প্রয়োজন মানে হলো, যতটা ভালো হওয়া দরকার ততটা ভালো সে নয়। তাছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আপনি হয়তো এটা জেনেও নেননি যে, সে আপনার পছন্দ অনুযায়ী পরিবর্তন হতে চায় কি না। পরবর্তী সময়ে নিজেকে বদলানোর ব্যাপারে তার নিজস্ব চিন্তাভাবনার কথা শুনে আপনি নিজেই হতবিহবল হয়ে পড়বেন। ফলাফল: বিবাহিত জীবনের করুণ পরিণতি।
সূত্রের দ্বিতীয় অংশটি হলো ক্ষমাশীল হওয়া। পরস্পরের ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে হবে। সাধারণত দাম্পত্যজীবনে যা হয়, আমরা চাই নিজের সকল ভুলত্রুটিকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা হোক। জীবনসঙ্গীর কাছ থেকে আমরা অনেক উঁচুমানের ব্যবহার আশা করি ঠিকই, কিন্তু আমরা নিজেরা তেমন আচরণ করতে পারি না। এমন অযৌক্তিক চিন্তা থেকে কোনো এক অজানা কারণে আমরা সরেও আসতে চাই না। বাস্তব জীবন আসলে এভাবে হয় না। মনে রাখবেন, অন্যের কাছ থেকে যেটা আশা করছেন, সেটা নিজে আগে করছেন তো?
দুজনের জীবনের সবকিছু ভাগাভাগি করে নিন। সে যা করতে পছন্দ করে তাতে আগ্রহ প্রকাশ করুন। সব বিষয়েই হস্তক্ষেপ করবেন না; বরং চেষ্টা করুন তার কাজগুলোকে আরও সুন্দর করতে।
কথোপকথন সুখী দাম্পত্য জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। একই সাথে এটা দাম্পত্য জীবনের মধুরতার পরিমাপক। দাম্পত্য সম্পর্ক ভেঙে পড়া শুরু হয় কথোপকথন হারিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। যখন ১০ মিনিট কথা বলার পরই দুজনের কারও বলার আর কিছু থাকে না; বরং একত্রে সময় কাটানো বলতে টিভির সামনে বসে থাকা, অথবা পত্রিকা পড়ায় রূপান্তরিত হয় তখন আপনি ধরে নিতে পারেন আপনাদের দাম্পত্য সম্পর্কে রোগ ঢুকেছে।
সুখী দাম্পত্য সম্পর্কে একে অন্যের সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য একটা ব্যাকুলতা থাকে। কেবল আনুষ্ঠানিকতা বা দায়িত্ব পালন নয়; এজন্যই আপনি বাইরে থেকে দ্রুত বাড়ি ফিরে আসতে চাইবেন যে আপনার স্ত্রী আপনার অপেক্ষায় রয়েছে। আপনি বাসায় এসেই আবার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে বেরিয়ে যাবেন না। কেবল অভিযোগ থেকে বাঁচার জন্য পরস্পরকে সময় দেবেন না; বরং আপনি সত্যিকার অর্থেই তার কাছে থাকতে, তার সান্নিধ্য পেতে ভালোবাসবেন।
একটা দাম্পত্য জীবনকে কীভাবে সফল করা যায়?
এক কথায় এর উত্তর হলো ‘কাজ করা”। আমরা বলি, 'দাম্পত্য জীবনকে সফল করো', কিন্তু আমরা ভুলে যাই এর অনেকটা অংশ আসলে ‘কাজ করা”। এর জন্য দরকার উদ্যোগ, সময় ও শক্তি। এটা কোনো বায়বীয় বিষয় নয়; আপনি আসলে কতটুকু করলেন তা পরিমাপ করা যায় এবং তার বিনিময়ে আপনি কী পেলেন তাও মূল্যায়ন করা যায়। যেমন ধরুন, আপনার স্ত্রীর জন্য নাস্তা তৈরি করা একটা কাজ, তেমনি তার কাজগুলো করে দিতে চাওয়া এবং সাহায্য করাও একটা কাজ। স্বামী ঘরে ফেরার সময়টাতে অগোছালো না থেকে একটু পরিপাটি হয়ে সেজেগুজে থাকাটাও একটা কাজ; অত্যন্ত মূল্যবান একটা কাজ। কোথাও যাওয়ার সময় একটু এগিয়ে গিয়ে বিদায় দেওয়া, কোথাও থেকে এলে একটু এগিয়ে অভ্যর্থনা জানানোও একটি কাজ। কীভাবে কাজ করতে হবে বুঝতে পারছেন তো? মন থেকে ইচ্ছে না করলেও, কিংবা নিজের পছন্দ না হলেও শুধু ‘ওর’ কথা ভেবে কিছু করাটাই হলো ‘কাজ’। আপনি যদি সত্যিই এগুলো করতে পারেন তাহলে বিনিময়ে সেটা আপনার জন্য এনে দেবে একরাশ ভালোবাসা আর আকাশছোঁয়া সম্মান।
আপনার স্বামী বা স্ত্রী আপনাকে সময় না দিলে অভিযোগ করবেন না। কারণ, প্রথমত এক্ষেত্রে অভিযোগ করার কাজটা দুঃখজনক এবং অবমাননাকর। দ্বিতীয়ত, আমার একটা নিয়ম হচ্ছে; কেউ যদি ভালোবেসে কোনো কাজ না করে, তাহলে নিছক কর্তব্য পালনের জন্য কাউকে কিছু করতে বলবেন না। তৃতীয়ত, সে যে অন্য কারও সঙ্গ খুঁজছে এটা আপনার জন্য একটা সতর্ক বার্তা; কাজেই নিজেকে পরীক্ষা করুন এবং সে অনুযায়ী কাজ করুন। খুঁজে দেখুন, কেন এমনটা হচ্ছে। নিজেকে শুধরে নিন। সব ঠিক হয়ে যাবে। মানুষ সবসময় আনন্দের বিষয়গুলোকেই খোঁজে। সুতরাং, আপনার সঙ্গ যদি আনন্দের চাইতে বেশি যন্ত্রণাদায়ক হয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই সে অন্য কোথাও তা খুঁজে পেতে চাইবে।
আমি প্রায়ই বলি, 'ঝগড়াটে কাউকে বিয়ে করার চেয়ে একটি ঘোড়া কেনা ভালো; ঘোড়াটি অন্তত বিভিন্ন জায়গায় ঘুরিয়ে আনতে পারত।' 'ঝগড়াটে” একটা উভলিঙ্গ শব্দ; নারী বা পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
আগেই যেমনটা বলেছি, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক কথাবার্তা থেকেই বোঝা যায়, তাদের বৈবাহিক সম্পর্ক কেমন যাচ্ছে। কী করতে হবে, কী করা যাবে না— সেই নির্দেশনা দেওয়া, অভিযোগ করা, কোনো তথ্য জানানো, পরনিন্দা-পরচর্চা করা কিন্তু এই কথোপকথনের মধ্যে পড়ে না। এই কথোপকথন বলতে বোঝায়— চিন্তা-ভাবনা, আশা, স্বপ্ন, ইত্যাদি শেয়ার করা; একে অন্যের কথাগুলো মন দিয়ে শোনা, সহানুভূতি দেখানো, পরস্পরকে বুঝতে চেষ্টা করা, হাসিকান্না ভাগাভাগি করে নেওয়া। দুজনে একসাথে বসে নীরবে কিছু সময় কাটানোও সুন্দর দাম্পত্য জীবনের একটি নিদর্শন। সবসময়ই যে কথা বলতে হবে এমন নয়। সাহচর্য কথা বলেও দেওয়া যেতে পারে, আবার নীরব থেকেও দেওয়া যেতে পারে; গুণগত মানটাই হলো সাহচর্যের মূল বিষয়। ব্যাপারগুলো আপনাকে কেউ ব্যাখ্যা করে না বললেও আপনি নিজেই বুঝে নিতে পারবেন। তবে খেয়াল রাখবেন, নীরবতায় কোনো দুশ্চিন্তা বা ক্লান্তি এসে ভর করছে কি না। মূল বিষয়টি হলো, একে অন্যের কথা আন্তরিকতা ও সম্মানের সাথে মন দিয়ে শুনতে ও জানতে চাওয়া।
অনুরাগ প্রকাশে কিছু পাগলামি করুন
জীবনসঙ্গীকে ফুল অথবা পছন্দনীয় কিছু উপহার দিন। কিন্তু তা কেবল জন্মদিন বা বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে নয়। তথ্য-প্রযুক্তির এ যুগে দিন-তারিখের এসব ছকবাঁধা জিনিস আজকাল আর কাউকে যত্ন করে মনে রাখতে হয় না, যন্ত্রগুলোই আমাদের মনে করিয়ে দেয়। বরং সম্ভব হলেই উপহার দিন। সবসময় যে বড় উপহার দিতে হবে এমনও নয়; বরং উপহার দেওয়ার ভাবনাটাই মূল বিষয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন যে তোমরা উপহার দাও, কারণ তা পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা বাড়িয়ে দেবে। সুতরাং একে অন্যকে উপহার দিন। যখন আপনি কিছু দিনের জন্য দূরে থাকেন, অথবা কদিন কাজে ডুবে থাকার কারণে মানসিকভাবে দূরত্ব সৃষ্টি হয় তখন উপহার দারুণ কাজ করে। উপহার সুন্দর দাম্পত্য জীবনকে জুড়ে রাখে আঠার মতো।
আর হ্যাঁ, উপহারটি আপনার সঙ্গীকে একান্তে দিবেন। উপহারটিকে র্যাপিং পেপারে মুড়িয়ে, রঙিন ফিতে দিয়ে বেঁধে, সুগন্ধী লাগিয়ে একগুচ্ছ ফুলসহ তার হাতে তুলে দিন। ঘটনাটিকে স্মরণীয়, বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ও সৃজনশীল করুন। মনে রাখবেন, উপহারের বস্তুটি কিন্তু এখানে মুখ্য নয়, এখানে মূল হলো একটি স্মরণীয় মুহূর্ত উপহার দেওয়া। উপহারটি এমন ব্যাগ ভরা কিছু হওয়ার দরকার নেই—যা সবার সামনে বের করে দেবেন। বরং এটা এমন কিছু হবে যা কেবল সে-ই পাবে। কোনো উপলক্ষ করে বা ঘটা করে কিছু করতে যাবেন না; বরং তাকে এমন সময় এমন কিছু দিন যা সে তখন আশা করেনি। উপহারটিই আপনার সঙ্গীর বিশেষত্ব প্রকাশ করে বলবে, “তুমি আমার বিশেষ একজন'। একই ঘটনা ছেলেদের ক্ষেত্রে ও প্রযোজ্য। মনে রাখবেন, ছেলেরাও কিন্তু উপহার পছন্দ করে; এমনকি অনেক ক্ষেত্রে মেয়েদের চেয়েও বেশি। তাদেরকেও উদার মন নিয়ে উপহার দিন।
একসঙ্গে আনন্দ উপভোগ করা
প্রবাদ আছে—যে দম্পতি একসাথে আনন্দ উপভোগ করতে পারে, তারাই দীর্ঘদিন একসঙ্গে থাকতে পারে। খেলাধুলা, বিনোদন, ঘুরতে যাওয়া, ছুটির দিন কাটানো, পিকনিকে যাওয়া বৈধতার সীমারেখার মধ্যে থেকে আপনার কাছে যেটাই আনন্দের বিষয় মনে হয় সেটাই করুন। এমন কিছু করুন যেটা দুজনে মিলে উপভোগ করতে পারবেন। যদি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ কোনো খেলা হয় তাহলে আপনি হেরে যাওয়ার চেষ্টা করুন, সঙ্গীকে জিতিয়ে দিন। মনে রাখবেন, এখানে হেরে যাওয়াটাই আপনার জন্য আনন্দের। সবসময় হয়তো বিষয়টিকে সমানভাবে উপভোগ নাও করতে পারেন, কিন্তু এর বিনিময়ে আপনার জীবনসঙ্গীর মুখে যে হাসি আপনি ফোটাতে পারছেন সেটাই অনেক বড় পাওয়া। এই হাসিটাই তো সব, তাই না? তাই, হাসিটা যেন সত্যিকারের হাসি হয়।
মেকি হাসি এক মাইল দূর থেকেও বোঝা যায়। সবসময় কৃতিত্ব জাহির করাটা মূল কথা নয়; সংসারে তো একেবারেই নয়। এখানে আপনার ‘কাজের মূল্যায়ন' নির্ভর করে আপনাদের উভয়ের সন্তোষ প্রকাশের মধ্য দিয়ে। দুজনে মিলেই কাজ করতে হবে, দুজনে মিলেই সফলতা অর্জন করতে হবে। না হলে বিষয়টা হবে এমন যেন, “অপারেশন সফল হয়েছে কিন্তু রোগী মারা গেছে'। বর্তমান যুগের এই ব্যস্ত জীবনে, আমাদের আসলে সময় হয়ে ওঠে না ‘এমনিতে’ কিছু করার। আমরা সবকিছুতেই ‘ফলাফল' খুঁজতে থাকি। দাম্পত্য জীবনের ক্ষেত্রে এটা অত্যন্ত ক্ষতিকর। এটা মানসিকভাবে ভীষণ পীড়া দেয়। বিয়ে হলো সুকুন, সুখ, মানসিক শান্তি, প্রশান্তি ইত্যাদি অমূল্য সব সম্পদ অর্জনের জন্য বস্তুগত কোনো 'ফলাফল' লাভের জন্য নয়। পরস্পরকে সময় দেওয়ার মাধ্যমে এ লক্ষ্য অর্জন আরও সহজ হতে পারে।
অসুখী দাম্পত্য জীবনে কীভাবে সুখ ফিরিয়ে আনা যায়?
কাজটা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত কঠিন, কারণ এর জন্য একটা পূর্বশর্ত আছে। আপনি যদি সেই পূর্বশর্তটা পূরণ করতে পারেন তাহলে অবশ্য বেশ সহজ। শর্তটা হচ্ছে, "আপনি কি সত্যিই চান আপনার দাম্পত্য জীবন সুখের হোক?” কথাটি শুনতে অদ্ভুত লাগতে পারে, কিন্তু আমি আমার দীর্ঘ কাউন্সেলিং জীবনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, সংসারে অশান্তির প্রধান কারণই হচ্ছে নিজেরা সত্যিকার অর্থে সুখ না চাওয়া। জীবনকে সুখময় করার ব্যাপারে তারা কেউই সচেতন ছিল না; বরং কেবল নিজেকে বা অন্যকে সন্তুষ্ট করার জন্য কিছু একটা করে বুঝ দিতে চাইছিল যে “তারা চেষ্টা করছে'। বাস্তবে কথাটি সম্পূর্ণ মিথ্যা; কেননা তারা কখনোই সত্যিকার অর্থে চেষ্টা করেনি। তারা অসমাপ্ত একটা নাটকে অভিনয় করে চলেছিল মাত্র।
আপনি যদি আন্তরিকভাবে পরিবর্তন চান তাহলে আপনার জীবনসঙ্গী যা যা পছন্দ করে তার একটা তালিকা করে ফেলুন। বিয়ের প্রথম দিকে তার কী কী গুণ আপনার যথেষ্ট পছন্দের ছিল নিশ্চয়ই মনে আছে সেগুলো? আপনি তা লিখে ফেলুন। একই সাথে সমস্যার বিষয়গুলোও লিখুন। সাধারণত এটা ম্যাজিকের মতো কাজ করে। যখন আমরা ভালো গুণগুলোর যথাযথ মূল্যায়ন করি না এবং অবদানগুলোর জন্য কৃতজ্ঞ হই না, তখন দাম্পত্য সম্পর্কে চিড় ধরাটাই নিয়তি। আমি প্রায়ই জিজ্ঞেস করি, 'দিনে কতবার আপনারা পরস্পরকে ধন্যবাদ জানান? দিনে ক'বার তাকে জড়িয়ে ধরেন, চুমু খান? দিনে কতবার তাকে বলেন, আমি তোমাকে ভালোবাসি?"
অদ্ভুত একটা বিষয় হলো, আমরা জীবনসঙ্গীর কাজকে খুব কমই মূল্যায়ন করি। অনেকেই মনে করেন, সমালোচনা না করাটাই যেন কাজের মূল্যায়ন। এমন চিন্তা একটি মারাত্মক ভুল। কারও কাজের সত্যিকার মূল্যায়ন করা মানে, সে আপনার জন্য যা করেছে তার সবকিছুর জন্য প্রত্যক্ষভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, 'যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না সে আল্লাহর প্রতিও কৃতজ্ঞ নয়।' কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা একটি সুন্দর দাম্পত্য জীবনের প্রাণ। মনে রাখবেন, নিয়মিত এ কাজটা করা একটি দারুন ব্যাপার। কোনো সমস্যা হলে তা বলতে যদি আমরা দেরি না করি, তাহলে সবকিছু সুন্দরভাবে চললে তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে কেন কার্পণ্য করব?
মনের মানুষ বলতে কি কিছু আছে?
আত্মার সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়, আপনাআপনি সৃষ্টি হয় না; একটু একটু করে যত্নের সাথে গড়ে তুলতে হয়। কখনো কখনো এজন্য অনেক সময়ের প্রয়োজন হয়। যে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এ সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে তাদের আপনি দেখবেন যে, তারা হয়তো কোনো বিষয় নিয়ে মুচকি হেসে যাচ্ছে, কী কারণে তারা দুজন হাসছে তা কেবল তারাই বুঝতে পারে। হয়তো দেখবেন তারা এমন একটা ভাষায় কথা বলছে যা কেবল তারাই বুঝতে পারছে। তাদের কথাগুলো হয়তো অন্যদের কাছে একেবারেই সাধারণ মনে হয়, কিন্তু তা তাদের পরস্পরের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। এটা যদি আপনি গড়ে তুলতে পারেন তাহলে ৩০ বছর পরেও দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে প্রেমে পড়বেন বারবার। হাসির ব্যাপারটাও এমনই গুরুত্বপূর্ণ। হাসির কিছু পেলে সেটা অন্যজনকে জানান, যেন সে-ও আনন্দ পায়। এই আনন্দ ভাগাভাগির মাঝেই এক ধরনের নির্মল আনন্দ রয়েছে।
সুখী দাম্পত্য জীবনের পেছনে কী কী বিষয় ভূমিকা রাখে?
আবারও বলছি, সত্যবাদিতা, যত্নবান হওয়া এবং পারস্পরিক সম্মানবোধই হলো দাম্পত্য সুখের মূলসূত্র। প্রতিটি কাজ এবং উদ্যোগকে এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতেই হবে। আপনি কি সত্যবাদী? জীবনসঙ্গীর প্রয়োজনকে কি আপনার নিজের প্রয়োজন হিসেবে দেখেন? আপনি তার জন্য অন্তরে যে সম্মান বোধ করেন তা কি প্রকাশ করেন? আমার স্পষ্ট মনে পড়ে আমার দাদা-দাদির কথা। প্রত্যেক বেলায় দাদি আমার দাদাকে নিজ হাতে খাবার পরিবেশন করতেন। তিনি দাদার প্লেটে নিজ হাতে খাবার তুলে দিতেন, তার পছন্দের টুকরোটা বেছে দিতেন, খেয়াল করে দেখতেন তার কী প্রয়োজন; চাওয়ার আগেই তিনি তা প্লেটে তুলে দিতেন।
বিশেষ কোনো কারণ না ঘটলে তিনি প্রতিবেলায় দাদার সাথে খেতে বসতেন। ঘরে একাধিক কাজের লোক থাকা সত্ত্বেও কারও অনুমতি ছিল না দাদাকে খাবার পরিবেশনের। তারা ট্রে নিয়ে দাদির সামনে হাজির করত, দাদি সেখান থেকে তুলে দাদাকে পরিবেশন করতেন। এই কাজগুলো করার সময় যে ভালোবাসা আর আন্তরিকতার ছাপ তার চোখে-মুখে ফুটে উঠত, আজ ৪০ বছর পর এবং তাদের দুজনের মৃত্যুর ২৫বছর পরও আমার মনে স্পষ্ট গেঁথে আছে। দাদি কেমন করে এ কাজগুলো করতেন? কারণ তিনি এই কাজগুলো করতে পছন্দ করতেন।
দাদাও এই ভালোবাসার বিনিময় দিতে কার্পণ্য করতেন না। তিনি প্রায় সব ব্যাপারেই দাদির সাথে পরামর্শ করতেন। কোথাও গেলে দাদিকে সাথে নিয়ে যেতেন। দাদির পছন্দ অনুযায়ী কাপড়চোপড় পরতেন। দাদি ছিলেন দাদার চেকবইবিহীন ব্যাংক। তিনি সে টাকাপয়সা নিয়ে কখনো প্রশ্নও করতেন না দাদিকে। এতটা বিশ্বাস এখনকার সময়ে খুব কমই দেখা যায়। দাদা কখনো দাদির সাথে গলা চড়িয়ে কথা বলেননি। সবসময় ভালোবাসার দৃষ্টি বোলাতেন। বলতে গেলে দাদী ছিলেন দানার প্রাণ।
তারা যে দুজন দুজনকে খুবই ভালোবাসতেন তা তাদের আচার-ব্যবহারেই ফুটে উঠত। দাদি আগে মারা গিয়েছিলেন। তিন মাস পর দাদাও দাদির কাছে চলে গেলেন। কিন্তু তারা তাদের সন্তান ও নাতি-নাতনীদের জন্য স্মৃতি রেখে গেলেন—কীভাবে দাম্পত্য জীবন যাপন করতে হয়, জীবনসঙ্গীর সাথে কেমন ব্যবহার করতে হয়।
দাম্পত্য জীবনে বাবা-মা এবং শ্বশুর বাড়ির লোকদের কতটুকু জড়ানো উচিত?
একটুকুও না। কারণ, এটা সংসারে ঝামেলা ডেকে আনার অন্যতম কারণ। বাবা- মা'র উচিত তাদের নিজেদের সংসার নিয়ে মাথা ঘামানো। একবার যখন আপনার সন্তানদের বিয়ে হয়ে যায়, তখন তারা আর শিশুসন্তান থাকে না। তাদেরকে তাদের মতো থাকতে দিন। তাদের সুবিধা অসুবিধা তাদেরকেই সামাল দিতে দিন। প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছে বলেই তো তাদের বিয়ে দেওয়া হয়েছে!
আমাদের সমাজের অনেক মা তাদের ছেলেদের বিয়ে দিতে আতঙ্কিত বোধ করেন। তারা মনে করেন, ছেলের বউ এলে তিনি তার গুরুত্ব হারাবেন। তাই ছেলের বউ ঘরে এলে তার সাথে এক ধরনের অলিখিত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। মনে রাখবেন, আপনি যদি আপনার ছেলের বউয়ের প্রতিযোগী হয়ে ওঠেন, আপনি হারলে তো হারলেনই; জিতলেও হারলেন। তাই এই পথ ছেড়ে দিন, ওদেরকে ওদের মতোই থাকতে দিন। তাদের দাম্পত্য জীবন, সাংসারিক কিংবা ব্যক্তিগত বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করবেন না। 'তোমরা কি সুখী?'—এ ধরনের প্রশ্ন তো ভুলেও করতে যাবেন না। বাবা-মা এবং শ্বশুর-শাশুড়ি যাদের দাম্পত্য জীবনে অতিরিক্ত আগ্রহ দেখিয়েছেন এমন কোনো সংসার আমি শান্তিপূর্ণভাবে টিকে থাকতে দেখিনি।
একই সাথে নব দম্পতিদের বলছি, আপনাদের দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে বাবা- মা'র অতি উৎসাহ দেখতে পেলে তাদের নিরুৎসাহিত করুন। বিয়ে করার যথেষ্ট বয়স যখন আপনাদের হয়েছে, সমস্যা সমাধানের বয়সও হয়েছে আপনাদের। সমস্যা হলেই যদি বাবা-মা'র কাছে দৌড়াতে হয় তাহলে ডায়পার পরে বসে থাকুন। আপনি আসলে সংসার করার জন্যই প্রস্তুত হননি এখনো। আপনার মা যদি আপনাকে ফোন করে বলেন, “যখন তুমি তাকে 'এটা' বলেছিলে তখন সে 'কী' বলেছিল?" তখন মা'কে বলুন, “সরি মা, ও আমাকে কী বলেছে সেটা আমি তোমাকে বলতে পারব না।” কথাটি হাসিমুখে এবং স্পষ্ট করে বলুন।
আপনাদের সমস্যা আপনারা দুজনে মিলে সমাধান করুন। আমি বলছি না যে আপনার বাবা-মা'কে আপনি অবহেলা করবেন; তবে মনে রাখবেন আপনার বিয়ের পরে আপনার জীবনসঙ্গী আপনার সবচাইতে বেশি মনোযোগ পাওয়ার দাবি রাখে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, প্রত্যেককে যার যার অবস্থানে রেখে আপনাকে আলাদা আলাদাভাবে সম্পর্ক রক্ষা করে চলতে হবে। একইভাবে যখন সন্তান হবে তখন সন্তানদের সাথে সম্পর্কের বিষয়টিও ভাবতে হবে। আমি অনেক দম্পতিকে দেখেছি যারা সন্তানের পেছনে এত সময় ব্যয় করে যে, নিজেরাই নিজেদের কাছে যেন অচেনা হয়ে পড়ে। ফলে, একসময় একে অপরের থেকে দূরে চলে যায়। বিয়ের পর এসব নানারকম সম্পর্কের প্রত্যেকটিকে যথাস্থানে রেখে সামাল দিয়ে চলতে পারাটাই মানসিক পরিপক্ষতা।
এ প্রসঙ্গে আমাদের সমাজে প্রচলিত 'অ্যারেন্জ ম্যারেজ' নিয়ে দুটো কথা বলব। বিয়ে কি আসলে 'অ্যারেন্জ' করা যায়? আসলে এটা হলো অধিক উপযুক্ত
যুগল খুঁজে বের করার চেষ্টা বা অ্যারেঞ্জ করা। আমার মনে হয় পরিবারের বৃহত্তর স্বার্থে এটি একটি উত্তম পদ্ধতি। বিশেষ করে আপনি যদি যৌথ পরিবারে বাস করতে চান তাহলে এমন কাউকে বিয়ে করা ভালো যাকে পরিবারের সব সদস্য পছন্দ করবে। যার সাথে আপনার পারিবারিক দিক থেকে সামঞ্জস্যতা ও সমকক্ষতা আছে বিয়ের জন্য তাকে বেছে নেওয়াই উত্তম।
'বিয়ে মানেই মানিয়ে চলা'। যতই মানিয়ে নেওয়া যাক না কেন, কাজটা মোটেও সহজ নয়। তাই যত কম মানিয়ে নিতে হবে ততই ভালো। অনেকটা ছুটি কাটাতে যাওয়া হোটেল রুমের মতো: আপনার ঘরের সাথে রুমটার যত মিল থাকবে তত সহজে মানিয়ে নেওয়া যাবে। ভয় পাবেন না, যতই মিল থাকুক না কেন তারপরও আপনাকে কিছু না কিছু মানিয়ে চলতেই হবে। তাই সেটা যত কমিয়ে নেওয়া যায় ততই ভালো।
এত কিছুর পরও একটা অনিবার্য কথা হলো, সন্তানের মতামত না নিয়ে বাবা-মা এবং পরিবারের উচিত নয় শুধু নিজেদের মনমতো বিয়ের 'আয়োজন' করতে যাওয়া। সন্তানকে চাপ প্রয়োগ করে বিয়ে দিতে চাওয়া অত্যন্ত মূর্খতা এবং বোকামি। এটা নিঃসন্দেহে পরবর্তীকালে গোটা পরিবারের জন্য দুঃখ-যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ছেলে-মেয়ে উভয়ের কাছে পরস্পরের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরে তাদেরকে নিজেদের মতো বাছ-বিচার করতে দিন। যদি তারা একে অপরকে পছন্দ করে এগিয়ে যায়, তাহলে তো খুবই ভালো। আর যদি তারা মনে করে এগোনো ঠিক হবে না, তাহলে আরও ভালো। শার'ঈ সীমারেখার মধ্যে থেকে পরস্পর সম্পর্কে জানতে সুযোগ করে দেওয়াটা একটা ভালো পদক্ষেপ। কেননা এতে করে আপনারা বাবা-মা'রাও দুই পরিবারের পরিবেশ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারবেন।
তবে হ্যাঁ, দুই পরিবারের পরিবেশ যতই মিলে যাক না কেন, বর-কনের বাবা-মা যতই ছেলেবেলার বন্ধু হোক না কেন, সম্ভাব্য জুটিকে তাদের মতো করেই চিন্তা করতে দিতে হবে। তাদের দুজনেরই স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তা রয়েছে, রয়েছে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ, রয়েছে জীবনের ব্যাপারে তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি। তাদের সিদ্ধান্ত তাদেরকেই নিতে হবে। নিজেদের সিদ্ধান্তের দায়ভারও নিতে হবে নিজেদেরকেই।
জীবনের এত বড় গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে, বাবা-মা'রা নিজেদের উদ্বেগের কারণে যদি বেশি হস্তক্ষেপ করে ফেলেন তাহলে তা গোটা বিষয়টাকে ভণ্ডুল করে দিতে পারে। অতিভদ্র যেসব 'অনুগত' সন্তান সিনেমার ডায়লগের মতো বাবা-মা'কে বলে, “তোমরা যাকে পছন্দ করবে আমি তাকেই বিয়ে করব'; এদেরকে আবার নার্সারিতে পড়ানোর জন্য ফেরত পাঠানো উচিত। কারণ, জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো পরিপক্কতা এখনও তাদের আসেনি। এমন আনুগত্য সব সময় ভালো ফল বয়ে আনে না।
হয়তো একসময় দেখবেন আপনার এই ‘অনুগত’ সন্তানই একদিন আপনার সামনে 'তালাকনামা' নিয়ে হাজির হয়ে বলবে, তাদের এই ধ্বংসের জন্য আপনারাই দায়ী। আমার ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে, বিয়ে করার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যে নিজ থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার মতো ক্ষমতা রাখে না, নিজের সিদ্ধান্তের দায়ভার যে নিতে পারে না, সে আসলে বিয়ে করার জন্যই প্রস্তুত নয়। এই দায়িত্বজ্ঞানহীন লোকদের উচিত অন্যের জীবন ধ্বংস না করে, বিয়ে করার মতো ম্যাচিউরড না হওয়া পর্যন্ত সময় নেওয়া, অপেক্ষা করা।
সাংসারিক জীবনে পরস্পরকে কীভাবে ছাড় দেওয়া যায়?
বিষয়টিকে ‘ছাড় দেওয়া' না বলে 'মানিয়ে নেওয়া' বলাটাই ভালো। এটা নিছক শাব্দিক অর্থগত কোনো বিষয় নয়; বরং এটা সম্পূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার যে, আপনি কোন শব্দ দিয়ে কী বোঝাতে চাচ্ছেন। ছাড় দেওয়ার বিষয়টি অনেকটা বাধ্য হওয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট; আমরা বাধ্য হলে তবেই ছাড় দিই। পক্ষান্তরে, আমরা কোনো কিছুর সাথে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা তখনই করি, যখন কাজটিকে আরও উপভোগ করতে চাই। কিছু বিষয় রয়েছে, যেগুলো নবদম্পতিরা ভাগাভাগি করে নিতে আপত্তি করে না।
যেমন: কিছু জিনিসের মালিকানা, ব্যক্তিগত সময় এবং নিজের একান্ত গোপনীয়তা ইত্যাদি। হয়তো এটা করতে কারও কোনো উপদেশও তাদেরকে দিতে হয়নি; অথবা হতে পারে বিবাহিত জীবনের প্রথম দিনগুলোতে মোহমুগ্ধ থাকার কারণে এগুলো নিয়ে হয়তো তখন তারা চিন্তাও করে দেখেনি। কিছু জিনিস আছে যেগুলো ভাগাভাগি করে নেওয়াটা তেমন কোনো কঠিন বিষয় নয়; কিন্তু তা যখন ব্যক্তিগত আরাম-আয়েশ, আচার ব্যবহার ও দীর্ঘদিনের অভ্যাস-অভ্যস্ততার উপর আঘাত হানে, তখনই বোঝা যায় আসলে কে কতটা সহনশীল। 'আমি' থেকে 'আমরা' হওয়াটা একটা কঠিন ব্যাপার। ছোট ছোট বিষয় অনেক সময় এমন বিরোধ তৈরি করে, যা অনেক সময় বড় ধরনের বিবাদের জন্ম দিতে পারে।
কিছু মানুষ স্বভাবগতভাবেই পরিচ্ছন্ন এবং সুশৃঙ্খল। আবার কেউ শৃঙ্খলাকে ব্যক্তিস্বাধীনতার উপরে ‘আঘাত' মনে করে। কেউ আগে ঘুমায়, আগে ওঠে। কেউ দেরিতে ঘুমায়, দেরিতে ওঠে। কেউ নাস্তা করে, কেউ করে না। কেউ কেউ স্টাইলিশ এবং ফ্যাশন সচেতন, কারও আবার যেমন তেমন একটা কিছু পরলেই চলে যায়। কিছু মানুষ চমক পছন্দ করে, অনেকে হয়তো সেটা অপছন্দ করে। অনেকে সিদ্ধান্ত নিতে পছন্দ করে—হোক ভালো কি মন্দ। অনেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না নিয়ে সমস্যা সমাধানের অপশনগুলো খোলা রাখে। অনেকের কাছে অবসরের বিনোদন মানেই একাকী নিভৃতে বসে থাকা। কেউ-বা আবার ভালোবাসার মানুষটির সাথে একান্তে নীরবে কিছু সময় কাটানোতেই অবসরের আনন্দ খুঁজে পায়। কারও কাছে বিনোদন মানে অনেকে মিলে হৈ-হুল্লোড় করে বেড়ানো, অনুষ্ঠানে যাওয়া, সেখানে নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হওয়া—কেউ হয়তো এই একই কাজটাকে অপছন্দ করে। কিছু মানুষ কোনো কাজের মধ্যে নিয়ম-শৃঙ্খলার শেকল দেখতে পায়, আবার কেউ হয়তো সেই একই কাজের মধ্যেই মানসিক প্রশান্তি খুঁজে পায়। সবকিছুর পার্থক্যকে যদি এভাবে আলাদা করে দেখা যেত তাহলে বেশ হতো। কিন্তু আদতে তা হয় না। আমরা বিষয়গুলোকে দেখি 'সঠিক' বা আমার পছন্দ এবং 'ভুল' বা আমার অপছন্দ হিসেবে। এ ধরনের পার্থক্য সাংস্কৃতিকভাবে আমাদের মজ্জাগত এবং আমাদের সবারই কমবেশি এমনটা হয়ে থাকে।
মেয়ার্স-ব্রিগস (Myers - Briggs) থিওরি সম্পর্কে যারা শুনেছেন তারা মনমেজাজের এইসব বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানেন। কিন্তু এই থিওরি সম্পর্কে আপনার ধারণা থাকুক বা না থাকুক আমি নিশ্চিত, আমার দেওয়া এ বর্ণনার মাঝে আপনি আপনাকে, আপনার জীবনসঙ্গীকে, আপনার পরিবার ও বন্ধুমহলের অনেক মানুষকে খুঁজে পাবেন।
বিয়ের পর আপনি হয়তো বুঝতে পারলেন যে, আপনি যাকে বিয়ে করেছেন সে আপনার চেয়ে একেবারেই ভিন্ন প্রকৃতির। এখন আপনি কী করবেন?
স্বাভাবিকভাবে আমরা জানি যে, পার্থক্য ও ভিন্নতা মানেই সমস্যা। আর তাই বিয়ের আগে আমরা আমাদের ভিন্নতাগুলোকে কিছু দিয়ে ঢেকে রাখার চেষ্টা করি। ভিন্নতাগুলোর সাথে আমরা খাপ খাইয়ে নিই, এগুলোকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখি, প্রায় সবকিছুর সঙ্গেই মানিয়ে চলি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিয়ের পর এগুলো মাত্র দু'সপ্তাহ টেকে। এরপরই মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে এসব পার্থক্যগুলোর বাস্তবতা। সংসার জীবনের পার্থক্যগুলোর প্রভাব নিছক তাত্ত্বিক আলোচনার চেয়ে অনেক বেশি।
এটা বাস্তব জীবন; আপনাকে প্রতিদিন অনেকবার করে এসব ভিন্নতার মুখোমুখি হতে হবে। আপনাকে সেগুলো সামলাতে হবে; না-হলে সমস্যা অনিবার্য। মজার ব্যাপার হলো, অনেকেই এমন পার্থক্য দেখেই বিয়ে করে; কারণ, এই ভিন্নতা বা বৈচিত্র্য বাইরে থেকে দেখতে বেশ আকর্ষণীয় লাগে। যে ব্যক্তি সবসময় সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে, তার কাছে স্বাভাবিকভাবেই সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম ব্যক্তিকে স্মার্ট মনে হয়। শান্তশিষ্ট, সুশৃঙ্খল নিয়মানুবর্তী ব্যক্তির কাছে স্বতঃস্ফূর্ত, চঞ্চল ও উদ্যমী মানুষকে মনে হয় গুমোট পরিবেশে মুক্ত বাতাসের মতো।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে এসব ক্ষেত্রে সম্পর্ক বেশি দিন স্থায়ী হয় না। যে বৈচিত্র্য একসময় তাকে মুগ্ধ করত তা-ই পরিণত হয় বিরক্তি, সম্পর্কের অবনতি ও পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতে।
তবে সৌভাগ্যজনকভাবে এরও একটা সমাধান আছে। আর সেটা হলো, পার্থক্যকে পার্থক্য হিসেবেই গ্রহণ করা এবং তা ভালো কি মন্দ সে বিষয়টা যথাসম্ভব এড়িয়ে যাওয়া। এরপর আপনাকে নিশ্চিত করতে হবে যে, আপনি আপনার জীবনসঙ্গীর এই ভিন্নতা নিয়ে কোনো সমালোচনা করবেন না, যদি না সেটা অনৈতিক বা অবৈধ কোনো বিষয় হয়। তাকে তার মতোই থাকতে দিন। এড়িয়ে যাওয়া শিখুন। সেইসাথে সবকিছুতেই জড়িয়ে যাওয়া, মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকুন। প্রতিক্রিয়া না দেখানোর অভ্যাস গড়ে তুলুন।
তবে হ্যাঁ, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ঠিক করে নিন। আদর্শিক এবং নীতিগত বিষয়ে কখনো ছাড় দেবেন না। কেন ছাড় দেবেন না, আপনার সঙ্গীকে সেটা বুঝিয়ে বলুন। আপনার জীবনসঙ্গী যদি বিচক্ষণ হয়, তাহলে তিনি আপনার সিদ্ধান্তকে সম্মান করবেন। একই সাথে যেসব বিষয় তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ সেগুলো নিয়েও ভাবুন। আপনি যদি সেসব বিষয় অনুসারে নিজেকে বদলে চলতে পারেন, তাহলে নিজেকে বদলে ফেলুন।
ইতিপূর্বে যে সচেতনতার ব্যাপারটি নিয়ে আমরা আলোচনা করেছিলাম তা কি মনে আছে? এটা মনে রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ যে, সবকিছুই আপনার পৌরুষত্ব বা নারীত্বের পরীক্ষা নয়। আপনি 'ছাড়' দিয়ে কখনো হেরে যান না, বরং আপনি অন্যের অন্তর জয় করে নেন। তাই মৌলিক মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক না হলে যথাসম্ভব মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করুন। এ পরিপ্রেক্ষিতে আপনাকে মনে করিয়ে দিতে চাই যে, ভিন্ন আকীদার, ভিন্ন ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির এবং অন্য ধর্মের কাউকে বিয়ে করা মানে ধ্বংসের বীজ বপন করা। তবে যারা ধর্মপালন এবং দীনদারির ব্যাপারে উদাসীন তাদের কথা আলাদা। আপনি যদি দীনের ব্যাপারে সচেতন হন, তাহলে এমন কাউকে বিয়ে করুন যে আপনার মতোই সচেতন এবং দীনের ব্যাপারে আপনার মতোই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে।
আপনি আপনার চিন্তাভাবনা, আদর্শ-বিশ্বাস এবং আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে খোলামেলা আলাপ করে নিতে পারেন; এটা খুবই ভালো। এ ধরনের আলোচনার ক্ষেত্রে একে অন্যের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। কোনো রকম বিচার করতে যাবেন না, ঐকমত্য বা দ্বিমত প্রকাশ করতে যাবেন না, তর্কও করবেন না। সম্মানের সাথে কথাগুলো শুনুন এবং তারপর চিন্তা করুন আপনি কী ভালোবাসেন, কী নিয়ে থাকতে পারবেন, আপনার ভেতরের কী কী পরিবর্তন আনতে পারবেন এবং কোন বিষয়গুলো নিয়ে আরও কথা বলা প্রয়োজন। বেশিরভাগ মানুষ এরকম আলাপ চলার সময়ে তাদের নিজেদের ভালো গুণগুলোকে জাহির করতে গিয়ে এমন সব কথা বলেন যার সাথে তাদের বাস্তব সত্তার কোনো মিল নেই।
অভিনয় কখনো দীর্ঘদিন টিকে থাকে না এবং কোনো না কোনো সময় এই মুখোশ খুলেই যায়। তাই বিয়ে করতে চাইলে শার'ঈ সীমারেখার মধ্যে থেকে খোলামনে সব বিষয়ে আলাপ করে নিন। এরপর সিদ্ধান্ত নিন আপনি বিয়ে করবেন কি না। কথা বলার সময়ে পরিষ্কারভাবে সবকিছু বলুন। সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিন, কোন বিষয়ে আপনি অনড় থাকবেন।
কূটনৈতিকভাবে সঠিক বা বিনয়ী হওয়ার ভান করবেন না। কোনো বিষয়ে আপনার কোনো দৃঢ় অভিমত থাকলে কথোপকথন ঠিক রাখার স্বার্থে সেটাকে লুকাবেপন না বা তুচ্ছ জ্ঞান করবেন না। হতে পারে সেটা আপনার ধর্মীয় কিংবা পারিবারিক মূল্যবোধ সংক্রান্ত কোনো বিষয়। হতে পারে সেটা মা'র সাথে একসঙ্গে থাকা, বা আপনার পোষা বিড়ালটি আপনার সাথে বিছানায় থাকবার মতো বিষয়। যা-ই হোক না কেন—এটা যদি গুরুত্বপূর্ণ কিছু হয় বলে দিন। পরে আবিষ্কার করার চাইতে আগেভাগেই সব বলে দেওয়া অনেক বেশি ভালো এবং কম যন্ত্রণাদায়ক। আপনার কাছে যেটা ‘তুচ্ছ' কোনো বিষয়, অন্যের কাছে সেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। তখন আপনি যদি তার মতের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখান তাহলে সেটা সাংসারিক জীবনে হবে বেশ বিপজ্জনক।
মানুষ কখন তার বৈবাহিক জীবনের ব্যর্থতা বুঝতে পারে? আর কখন সেই ব্যর্থতা নিরসনের উদ্যোগ নিতে হবে?
বিয়ে আসলে পারস্পরিকভাবে উপকৃত হওয়ার উদ্দেশ্যে দুজন মানুষের একত্রে বাস করার একটি চুক্তি। যখন আপনি দেখতে পাবেন দুজনের কারও কোনো উপকার হচ্ছে না; বরং একসঙ্গে থাকাটা আনন্দের চেয়ে বেশি যন্ত্রণার, তখন বুঝতে হবে বৈবাহিক জীবন সফল হচ্ছে না। তখন নিজেকে অবশ্যই এই প্রশ্নগুলো করতে হবে:
- * আমি কি এটা সফল করতে চাই?
- * একে সফল করতে কী কী প্রয়োজন?
- * আমি কি সেই প্রয়োজনীয় কাজগুলো করতে আগ্রহী?
যদি এই সবগুলো প্রশ্নের উত্তর হয় হ্যাঁ-বাচক, তাহলে এক্ষুণি কাজ শুরু করুন। আর যদি না-বাচক হয় তাহলে ইতি টানার সময় হয়েছে। তবে আপনি যদি বিবাহ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়েও থাকেন তবুও প্রথম তিনটি শর্ত—— যথা: সত্যবাদিতা, সচেতনতা এবং পারস্পরিক সম্মানবোধের কথা স্মরণ রাখবেন। নিশ্চিত করুন যে আপনি যা করছেন তা একটুও অনৈতিক নয়; বরং তা সম্পূর্ণ সততার উপর প্রতিষ্ঠিত।
অপরজন যেন খারাপ কোনো অনুভূতি নিয়ে বিদায় না নেয়। বিচ্ছেদ ব্যাপারটি এমনিতেই অনেক কষ্টদায়ক। এর সঙ্গে অতিরিক্ত আর কোনো নেতিবাচকতা যোগ করা থেকে বিরত থাকুন। পরস্পরকে শ্রদ্ধা করুন। আপনি এবং আপনার দাম্পত্য-জীবন উভয়েরই এ শ্রদ্ধা প্রাপ্য। অনন্যোপায় হলে বিচ্ছেদে দোষের কিছু নেই, কিন্তু অবশ্যই সেটা করবেন পারস্পরিক শ্রদ্ধা বজায় রেখে এবং সম্মানজনক উপায়ে।
একটা সংসারে স্বামী-স্ত্রীর মূল দায়িত্ব কী ? স্বামী ও স্ত্রীর জন্য কি এগুলো আলাদা?
আমার মতে একজন পুরুষের মূল দায়িত্ব উপার্জন করা ও পরিবারের সদস্যদের জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি অন্যান্য আর্থিক দায়িত্ব পালন করা। অন্যদিকে নারীর মূল দায়িত্ব হচ্ছে ঘরকে একটি সুন্দর সুখের নীড়ে পরিণত করা এবং সন্তানদের লালনপালনের দিকে খেয়াল রাখা। আমি জানি, অনেকের কাছে এটাকে সেকেলে মনে হতে পারে। আমি তাদের বলব, আধুনিক কালের এই ইয়াপপি-পাপপি সংস্কৃতির ভয়াবহ পরিণতির দিকে একবার তাকিয়ে দেখুন, তাহলে আপনি খুব শিগগিরই মূলের দিকে ফিরে আসবেন।
মূল দায়িত্ব পালনের পর পুরুষকে বাসার কাজগুলোতেও যথাসাধ্য সাহায্য করতে হবে। যেমন: সন্তানদের দেখাশোনা করা, স্ত্রীকে রান্নাবান্না ও খাবার তৈরিতে সাহায্য করা, কাপড়চোপড় ধোয়া, ঘরদোর গুছিয়ে রাখা ইত্যাদি। চায়ের মগ হাতে নিয়ে টিভির সামনে সোফার উপর পা গুটিয়ে অলস বসে থাকা মোটেই কাম্য নয়।
একইভাবে একজন স্ত্রী তার মূল দায়িত্বগুলো পালনের পর যদি স্বামীর কাজে সহযোগিতা করেন সেটা নিশ্চয়ই প্রশংসার দাবি রাখে। আশা করি বুঝতে পারছেন আমি কী বলতে চাচ্ছি।
দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নেওয়াটা খুবই ভালো একটা গুণ। সব করতে না পারেন, যে কাজটি ভালো লাগে সেটি অন্তত করুন; তবুও কাজ করুন। সংসারের কাজে কার কী ভূমিকা থাকবে, তার স্বচ্ছতা থাকা একটি সুখী দাম্পত্য জীবনের জন্য অপরিহার্য। কারণ, এটা যদি স্পষ্ট না থাকে তাহলে সেটা নিয়ে এমন দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হতে পারে যা দুজনের সম্পর্কে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করবে।
স্বামী-স্ত্রীর যেকোনো একজন সন্তান প্রতিপালন ও তাদের শিক্ষা-দীক্ষার কাজে বিশেষভাবে নিয়োজিত থাকবেন। তাদেরকে দীনের সঠিক শিক্ষা, আচার-আচরণ শেখাবেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং মূল্যবোধ শিক্ষা দেবেন। দেবেন সুস্থ চিন্তা করার খোরাক। আজকের এই আধুনিক ইয়াপপি-পাপপি সংস্কৃতিতে অনেকে মনে করেন যে শিশুদের যত্ন নেওয়া মানে হলো কেবল তাদের খাওয়ানো, গোসল করানো এবং বিনোদনের ব্যবস্থা করা। এই ধারণাটাই সকল মন্দের মূল। শুধু খাবার, একটা বিছানা আর খেলনা প্রয়োজন আপনার পোষা কুকুর বা বিড়ালের; আপনার সন্তানের প্রয়োজন আরও অনেক কিছু, অনেক বড় কিছু।
আপনি যদি তাকে যথার্থ মানুষ হিসেবে তৈরি করতে চান—যে হবে আপনার উত্তরসূরি—তাহলে খাবার, পোশাক, আশ্রয় বা খেলনার চেয়েও তাদের অনেক বেশি প্রয়োজন আপনার হাস্যোজ্জ্বল দৃষ্টি। এ ব্যাপারে আপনার নিবেদিতপ্রাণ হওয়া দরকার; কারণ সন্তানদের জন্য এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
আমি অনেক মা-বাবাকে দেখেছি যারা জীবনের শুরুতে অনেক কঠোর পরিশ্রম করেছেন। এরা অনেকে অশ্রুসিক্ত আবেগ নিয়ে বলেন, “আমি কখনো আমার সন্তানকে আমার মতো কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হতে দেব না।' আমি যখন এ ধরনের কোনো কথা শুনি, তখন আমি তাদের বলি, “কথাটা ওভাবে না বলে এভাবে বললেই তো পারেন—‘আমি আমার সন্তানকে কখনো স্থিরচিত্ত, শক্ত- সমর্থ ও সাহসী হয়ে গড়ে উঠতে দেব না; সফলতা অর্জনে আমার যে সামর্থ্য আছে সেটা তাদের অর্জন করতে দেব না।' কেননা বাস্তবে আপনাদের কথার অর্থ এটাই।” এঁদের অনেকের কাছে আমার এ বক্তব্যটি একটি কঠিন আঘাত। সন্তান প্রতিপালনের বিষয়টিকে তারা এভাবে কোনোদিন ভেবেও দেখেননি।
আপনি যদি সন্তানকে আগলে ধরে জীবনের বাস্তবতা থেকে দূরে রাখতে চান, তাকে জীবনযুদ্ধে গিয়ে প্রতিযোগিতা করতে দিতে না চান; আপনি যদি না চান যে, সে আঘাতের পর আঘাত আসা সত্ত্বেও পরাজয়ের গ্লানি মুছে আরও সাহসী ও উদ্যমী হয়ে সামনে এগিয়ে যাক; আপনি যদি না চান যে, যেকোনো সংকট মোকাবেলায় সে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম হোক; বরং আপনি যদি চান যে, সে সমস্যায় পড়লেই দৌড়ে এসে আপনার কাঁধে মাথা রাখবে এবং বক্সভরা টিস্যু দিয়ে আপনি তার চোখ মুছে দেবেন, তাহলে মনে রাখবেন – আপনিই আপনার এই সন্তানটির সবচেয়ে বড় শত্রু।
জীবনযুদ্ধে ব্যর্থ হওয়ার দিকেই আপনি নিজ হাতে তাকে ঠেলে দিচ্ছেন। আপনি নিজেই তার জীবন ধ্বংসের পাণ্ডুলিপি লিখছেন। এমনভাবে তাকে বড় করে তুলছেন যে সে জীবনে পরজীবীর মতো বেঁচে থাকবে। এভাবে সে পৃথিবীর কোথাও সম্মান পাবে না, বরং সবসময় তাকে ক্ষত-বিক্ষত আত্মসম্মানবোধ নিয়ে বর্ণহীন জীবনযাপন করতে হবে। নিগৃহীত এ জীবন তার ভেতরে এক ধরনের ক্ষোভ সৃষ্টি করবে। আর এই ক্ষোভের প্রভাব প্রথমেই পড়ে জীবনসঙ্গীর উপর। কেননা, মানুষ তার রাগ-ক্রোধ সবচেয়ে সহজে তার জীবনসঙ্গীর উপরই ঝাড়তে পারে।
লড়াই-সংগ্রাম মানুষকে শক্তিশালী করে; বিরূপ পরিস্থিতি শেখায় জীবন-যুদ্ধে কীভাবে টিকে থাকতে হবে। নির্মমতা ও কঠোরতা শেখায় কী করে জিততে হয়।
অনেক মা-বাবা এই বিষয়গুলো বোঝেন না। আর তাই চিরজীবন সন্তানের কল্যাণ কামনা করে গেলেও তারাই তাদের সন্তানের ধ্বংসের গোড়াপত্তন করে দেন। অনেক মা-বাবা টাকাপয়সাকে যোগ্যতার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। যার কারণে অত্যন্ত ব্যয়বহুল শিক্ষার ব্যবস্থা করে তারা সন্তানকে বাস্তবতা বিবর্জিত পরিবেশে বড় করেন। সন্তানরা তখন আর শিখতে পারে না—জীবনের সত্যিকার সমস্যাগুলোর মুখোমুখি কীভাবে হতে হয়। আদর করে তারা সন্তানদের অনেক দামি দামি খেলনা কিনে দেন। আর এর মধ্য দিয়ে সন্তানেরা মানুষকে নিছক বস্তুগত দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে মূল্যায়ন করতে শেখে। তাদের মনে গেঁথে যায়, যাদের দামি দামি খেলনা রয়েছে তারাই 'সেরা' শিশু। এরকম মা-বাবারা সন্তানদের দারিদ্র, সম্পদের সীমাবদ্ধতা এবং কোনো কিছু হারানোর বেদনা সম্পর্কে ধারণা দেন না। জীবনের কঠিন, উচ্চাভিলাষী ও বড় বড় লক্ষ্য অর্জনের জন্য যে উদ্যম, উচ্চাকাঙ্ক্ষা দরকার সেগুলো থেকে তারা তাদের সন্তানদের 'রক্ষা' করেন।
যেসব সাধারণ মানুষদের সাথে তাদের লেনদেন করতে হবে, সম্পর্ক রক্ষা করতে হবে, সেসব সাধারণ মানুষ আর সন্তানদের মাঝে বাবা-মা'রা দেয়াল হয়ে দাঁড়ান। এ লোকগুলোই একদিন তাদের প্রতিষ্ঠানে কাজ করবে, তাদের প্রতিষ্ঠানের গতি- প্রকৃতি নির্ধারণ করবে। অনেক সময় তাদের প্রয়োজন হবে মানুষকে অনুপ্রেরণা ও নেতৃত্ব দেওয়ার, যত্ন নেওয়ার এবং সমর্থন যোগানোর, মানুষকে বোঝার। শুধু ভালো কাজ করা এবং দান করার জন্যই নয়; বরং ব্যবসা-বাণিজ্য ও পারিবারিক জীবনের সফলতা অনেকাংশে নির্ভর করে এই বিপুলসংখ্যক মানুষের উন্নয়নে কাজ করার মাঝে।
সন্তানস্নেহে অন্ধ মা-বাবারা ভুলে যান যে, একদিন এই ছোট্ট নরম তুলতুলে মানব ছানাটিকেই বিশাল পৃথিবীর জঙ্গলে প্রবেশ করতে হবে। আর তখন যদি সে প্রস্তুত না থাকে তাহলে অন্যদের নেতৃত্ব দেওয়া তো দূরের কথা, সে নিজেই টিকে থাকতে পারবে না। মনে রাখবেন, সন্তানদের সমর্থন প্রয়োজন, পাহারা নয়। তাদের উপদেশ প্রয়োজন, কিন্তু ঠিক কী করতে হবে হুবহু তা বলে দেওয়া নয়। তাদেরকে তাদের নিজ জীবনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে, কিন্তু তা যেন মূল্যবোধ, স্বচ্ছতা ও দায়িত্ববোধের দৃষ্টিকোণ থেকে অপকারী না হয়।
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মানুষ যে কষ্টের মধ্যে আছে তার জন্য সহমর্মিতাবোধ থাকতে হবে, তাদের জন্য চোখে পানি আসতে হবে। বৈধতার সীমারেখার মধ্যে থেকে তাদেরকে মানুষের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে দিতে হবে। তথাকথিত সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবধান, ধর্ম, বংশ ও জাতীয়তার সীমানা ছাড়িয়ে মানুষের সাথে মিশতে দিতে হবে। তাদের শেখা উচিত যে, ‘গরিবেরা নীচ, সম্মানহীন এই ধারণাটা মোটেই ঠিক নয়। একইভাবে ধনী হলেই যে সম্মানিত হবে এমনটাও ঠিক নয়।
সন্তানদের শেখাতে হবে, সদগুণ একটা মনের ব্যপার। কেউ দেখছে বলে আমরা ভালো কাজ করি, এমনটা যেন না হয়। ভালো কাজ করার যে সিদ্ধান্ত আমরা নিয়েছি, যে অবস্থানে আমরা দাঁড়িয়েছি, এটা আমাদের নিজেদের ব্যক্তিত্ববোধ থেকেই নিয়েছি।
সন্তানদের অবশ্যই শিক্ষা ও শিক্ষকদের মর্যাদা শেখাতে হবে। যেসব সন্তানেরা শিক্ষকদের সম্মান করতে জানে না, তারা জ্ঞানের প্রকৃত কল্যাণ থেকে বঞ্চিত আজকালকার অনেক তরুণ ও অজ্ঞদের মাঝে ব্যাপকভাবে এই রোগ বাসা বেঁধেছে। কেউ চাইলে অজ্ঞ থাকতেই পারে; নিজের জীবনকে কেউ যদি নিজেই ধ্বংস করে ফেলতে চায় তাহলে কার কী বলার আছে!
আমি আসলে যেমন, তেমন কাজই করি। আর আমি যা করি, সেটাই আমি হয়ে যাই, সেটাই আমার পরিচয় হয়ে দাঁড়ায়। সন্তানদের শেখানো উচিত তারা যা করে সেটাই তাদের পরিচয় তুলে ধরে। আমাদের সম্পদ দেখে নয়; বরং আমাদের অবদান দেখেই লোকেরা আমাদের চিনবে। লোকেরা আমাদের কাজের উপর ভিত্তি করেই আমাদের সম্মান করবে। কারণ, আমরা কী ছিলাম বা আমাদের কী ছিল সেজন্য মানুষ আমাদেরকে তাদের মনে জায়গা দেয় না, তাদের জন্য কী করলাম সেজন্যই তারা আমাদের মনে রাখবে।
মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করার বিষয়টি যদি তারা শিশুকাল থেকেই শিখতে পারে, কেবল তখনই তারা ভোগবাদী সমাজ-ব্যবস্থার ভোগের উপকরণগুলো বর্জনের মানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠতে পারবে। অন্ধ আত্মকেন্দ্রিকতা ও স্থূল ভোগবাদিতা আমাদের সবাইকেই গ্রাস করে ফেলবে, যদি আমরা এর প্রাদুর্ভাব এখনি রোধ না করি। আরও পড়তে বই ডাউনলোড করুন
- বইটির লেখক-প্রকাশক, কারোরই আর্থিক ক্ষতি আমাদের কাম্য নয়। বরং বইটিকে আরও বেশি পাঠকের কাছে পৌঁছে দেয়াই আমাদের মূল উদ্দেশ্য। তাই বইটির মূল সংস্করণ নিজের জন্য সংগ্রহ করুন এবং প্রিয়জনদের উপহার দিন। ধন্যবাদ
FAQ
বই: বিয়ে স্বপ্ন থেকে অষ্টপ্রহর
লেখক : মির্জা ইয়াওয়ার বেইগ
প্রকাশনী : সিয়ান পাবলিকেশন
বিষয় : পরিবার ও সামাজিক জীবন, বিয়ে
বিয়ে স্বপ্ন থেকে অষ্টপ্রহর pdf download করতে নিচে ডাউনলোড বাটন ক্লিক করুন।