সাহাবিদের চোখে দুনিয়া pdf free download, ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল (রহিমাহুল্লাহ) |
একটু পড়ুন - অনুবাদকের কথা
যুহদ বা দুনিয়াবি মুখতার অর্থ হলো দুনিয়ার লোভ-লালসা ও দৃশ্যমান বস্তুরাশির প্রেম থেকে চিত্তের পবিত্রতা। দুনিয়ার ধ্বংস অনিবার্ব, পার্থিব যা-কিছু রয়েছে তার কোনোকিছুরেই স্থায়িত্ব নেই এবং পার্থিবতার মোহ আত্মার প্রশাস্তি ও চিত্তের পবিত্রতার জন্য ক্ষতিকর—এটিই দুনিয়াবিমুখতার মৌলিক তাৎপর্য। সুয়ান সাওরি রহ বলেছেন, যুহেদর অর্থ হলো দুনিয়াবি আশা-আকাঙ্ক্ষা কম থাকা। যুহদ হলো পৃথিবীর আবাসস্থল থেকে আখেরাতের উদ্দেশে আত্মার ভ্রমণ। আল্লাহর ওলি শ্রেণির সকল মানুষের অন্তরই এরূপ ভ্রমণানন্দে সদা উৎফুল্ল ও উচ্ছ্বসিত। তবে দুনিয়াবিমুখতার অর্থ এটা নয় যে, দুনিয়াকে সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করে সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করা এবং সকল মানবীয় সম্পর্ক বর্জন করা।
ইমাম আহমদ বিন হাম্বল বলেন, যুহদ হলো তিন পর্যায়ের : ১. হারাম বস্তু পরিত্যাগ করা, এটা সাধারণ মানুষের যুহদ বা পরহেযগারিতা। ২. প্রয়োজনাতিরিক্ত হালাল বস্তু পরিত্যাগ করা বা জীবনের জন্য যতুটুক দরকার তার চেয়ে বেশি গ্রহণ না করা। এটা হলো বিশেষ ব্যক্তিদের যুহদ। ৩. যুহদের আরো উচ্চতর পর্যায় রয়েছে। তা হলো যা- কিছু আল্লাহর স্মরণ ও আল্লাহর প্রেমে বিঘ্ন সৃষ্টি তা পরিত্যাগ করা। এটা আরেফ বা আল্লাহর নূর দ্বারা যাদের চিত্ত আলোকিত তাদের বৈশিষ্ট্য।
ইসলাম দুনিয়াকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করতে বলে না; বরং যা-কিছু মন্দ ও হীন, যা-কিছু আত্মার ও চিত্তের পবিত্রতার জন্য ক্ষতিকর, যা-কিছু আল্লাহর ও বান্দার সম্পর্কের মধ্যে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় তা পরিত্যাগ করতে বলে। আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজিদে বলেছেন, 'আল্লাহ তোমাকে যা দিয়েছেন তার দ্বারা আখেরাতের আবাস অনুসন্ধান করো এবং দুনিয়া থেকে তোমার অংশ ভুলে যেয়ো না।' [সুরা কাসাস : আয়াত ৭৭] আল্লাহ তাআলা আরো বলেছেন, 'মহাকালের শপথ, মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত, কিন্তু তারা নয় যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয় ও ধৈর্যের উপদেশ দেয়।' [সুরা আসর : আয়াত ১-৩]
সততা, সচ্চরিতা, অল্পেতুষ্টি, ধৈর্য ও কৃতজ্ঞতা, আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুলই হলো যুহদ বা দুনিয়াবিমূখতার প্রধান অনুষঙ্গ। ইসলাম দুনিয়াকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করে কেবল আখেরাতের প্রতি নিবিষ্ট হতে বলে না বরং মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে বলে। ভারসাম্যপূর্ণ জীবনব্যবস্থা ও মধ্যপন্থা অবলম্বন ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। যাঁরা আল্লাহকে পেতে দুনিয়াকে বর্জন করেছেন এবং পার্থিব কর্মকাণ্ড থেকে নিজেদের
গুটিয়ে নিয়েছেন তাঁরা নিজেদের জন্য তা আবশ্যক করে নিয়েছেন, শরিয়তের পক্ষ থেকে তাদের ওপর তা আবশ্যক করা হয় নি। যুদের মৌলিক তাৎপর্য হলো সব ধরনের পাপাচার ও সন্দেহজনক কাজ থেকে বিরত থাকা এবং অন্তঃকরণকে ষড়রিপুর আক্রমণ থেকে সুরক্ষা প্রদান করা। আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজিদে বলেছেন, 'সে-ই সফলকাম হবে যে নিজেকে পবিত্র করবে এবং সে-ই ব্যর্থ হবে যে নিজেকে কলুষাচ্ছন্ন করবে।' [সুরা শাসস : আয়াত ৯-১০] চারিত্রিক সততা ও আত্মিক পবিত্রতা যুহদ ও তাকওয়া অর্জনের অন্যতম শর্ত। নিজেকে পাপকাজের সংস্পর্শে রেখে ও সন্দেহজনক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত রেখে যুহদ ও তাকওয়া অর্জন সম্ভব নয়।
যুহদ অর্জনকারী বা দুনিয়াবিমুখের বৈশিষ্ট্য হলো আল্লাহ তাআলা তাঁকে যে-নেয়ামত দিয়েছেন তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকবেন, কোনোকিছু না-পাওয়ার কারণে আফসোস করবেন না, কষ্ট পাবেন না। আল্লাহ তাআলা ছাড়া তাঁর চিত্ত অন্যকিছুর প্রতি আকৃষ্ট হবে না; আল্লাহর কাছে যা রয়েছে তা তাঁর কাছে অধিকতর বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে; তাঁর নিজের কাছে যা রয়েছে তার ওপর তিনি নির্ভরশীল হবেন না। আল্লাহ তাআলা ও তাঁর ইবাদত থেকে যা-কিছু তাঁকে ব্যস্ত করে তোলে তা থেকে তিনি দূরে থাকবেন ও এড়িয়ে চলবেন। তিনিই প্রকৃত যাহেদ যিনি একনিষ্ঠতার সঙ্গে নবীজী সা.-এর সুন্নাহ ও জীবনপথ অবলম্বন করেন। ইবনে রজব হাম্বলি রহ. বলেছেন, আল্লাহর প্রতি, অর্থাৎ, আল্লাহর সিদ্ধান্তের প্রতি সম্বষ্টিই যুহ্যের মূলকথা। ফুয়াইল বিন ইয়াও একই কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, অল্পেতুষ্টিই হলো দুনিয়াবিমুখতা, এটিই প্রকৃত সফলতা। [জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম ]
যে-বান্দার ঈমান ও বিশ্বাস পরিপূর্ণ তিনি জীবনের যাবতীয় কর্মকাণ্ডে আল্লাহর প্রতি ভরসা রাখবেন, আল্লাহর সিদ্ধান্তের প্রতি সন্তুষ্টচিত্ত থাকবেন। তিনি মানুষের সঙ্গে অহেতুক সম্পর্কে ও অকারণ কথাবর্তায় জড়াবেন না এবং সন্দেহপূর্ণ ও অপছন্দনীয় উপায়ে সম্পদ বা জীবিকা উপর্জন করবেন না। ধন-সম্পদ এবং ক্ষমতা ও পদের প্রতি তাঁর লোভ-লালসার ছিটেফোঁটাও থাকবে না। যিনি এ-সকল বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে পারবেন, দুনিয়াতে তিনিই হবেন প্রকৃত যাহেদ বা দুনিয়াবিমুখ। তিনি সবচেয়ে সচ্ছল, যদিও পার্থিব ধন-সম্পদ তাঁর না থাকে।
প্রকৃত যাহেদ বা দুনিয়াবিমুখ কে এমন প্রশ্নের জবাবে ইমাম যুহরি রহ. বলেছেন, হারাম বস্তু ও অর্থ তাঁর ধৈর্যকে পরাভূত করবে না এবং হালাল বস্তুর আধিক্য আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন থেকে তাকে বিরত রাখবে না। অর্থাৎ, হারাম সম্পদ যদি তাঁর পায়ের কাছে বিপুল পরিমাণেও পড়ে থাকে তবুও তিনি ধৈর্য ধারণ করবেন এবং এসব সম্পদ পায়ে ঠেলে দূরে সরিয়ে দেবেন। আর যখন হালাল সম্পদ অর্জিত হবে তা আল্লাহর নেয়ামতরূপে গ্রহণ করবেন, উপকারী ও ভালো কাজে ব্যয় করবেন এবং
আল্লাহর প্রতি বিনীত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবেন। [জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম ]
সুফয়ান ইবনে উইয়াইনাহ রহ. বলেছেন, যিনি নেয়ামত পেয়ে শুকরিয়া আদায় করেন এবং বিপদাপদে ধৈর্য ধারণ করেন তিনি যাহেদ। সুয়ান সাওরি রহ. বলেছেন, আশা-আকাঙ্ক্ষার স্বল্পতাই হলো যুহদ; শুকনো খাদ্য গ্রহণ ও আলখাল্লা পরিধানের নাম যুহদ নয়। তিনি আরো বলেন, পূর্বসূরিদের দোয়া ছিলো এরূপ : 'হে আল্লাহ, দুনিয়াতে আমাদের যাহেদ বানান এবং সচ্ছলতা দান করুন; দুনিয়াকে আমাদের থেকে গুটিয়ে নিয়ে দুনিয়ার প্রতি আমাদের আকৃষ্ট করবেন না।”
ইবনে কায়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ রহ. বলেছেন, যাহেদের বৈশিষ্ট্য হবে এরূপ : “হে আল্লাহ, আমরা তোমারই ইবাদত করি এবং তোমার কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করি।' [সুরা ফাতিহা : আত্মাত ৪] অর্থাৎ, যাহেদের দৈনন্দিন জীবনের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য হবে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন। তাঁর পোশাকে আড়ম্বর থাকবে না, তার পানাহারে বিলাস থাকবে না; তিনি যেখানেই থাকবেন এবং যে-অবস্থাতেই থাকবেন, সবসময় আল্লাহর নির্দেশ পালন করবেন। যারা সত্য ও সততার ওপর রয়েছে তারা তাঁকে বন্ধু মনে করবে এবং তারা মিথ্যা ও বাতিলপন্থী তারা তাকে ভয় করবে। তিনি হবেন উপকারী বৃষ্টির মতো; সবাই তাঁর থেকে উপকার গ্রহণ করবে। তিনি এমন বৃক্ষের মতো যার পাতা কখনো ঝরে পড়ে না; যার ফল, পত্রপল্লব, ডাল, এমনকি কাঁটাও উপকারী। তাঁর চিত্ত সবসময় আল্লাহর প্রতি অনুরক্ত থাকে, আল্লাহর স্মরণে তাঁর আত্মা প্রাশান্ত হয়। তিনি বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহ তাআলা সবসময় তাঁর সঙ্গে রয়েছেন। [প্রাগুক্ত]
আমাদের সালফে সালেহীনগণ যুদ-বিষয়ে অসংখ্য কিতাব রচনা করেছেন এবং মুসলিম উম্মাহকে সত্য ও সুন্দর এবং পবিত্রতা ও কল্যাণের পরিচালিত করতে সচেষ্ট থেকেছেন। যুহদ-বিষয়ে যাঁরা গ্রন্থ রচনা করেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ.। তাঁর 'কিতাবুয যুহদ'-এর দ্বিতীয় অংশের অনুবাদ আমি করেছি। মূলানুগ থেকেও সাবলীল অনুবাদ করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। বইটি প্রকাশের সকল স্তরে যাঁরা শ্রম ও প্রচেষ্টা ব্যয় করেছেন তাঁদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাই। আল্লাহ তাআলাই উত্তম তত্ত্বাবধায়ক।
সম্পুর্ন লেখা টি সাহাবিদের চোখে দুনিয়া ফ্রী পিডিএফ বই থেকে নেওয়া পিডিএফ টি ডাউনলোড করতে নিচে ডাউনলোড বাটন ক্লিক করুন